বউ-ঠাকুরানীর হাট
হৃদয়ের কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজ, কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কথা, তাঁহার স্মৃতির ভাণ্ডারে ছোটো ছোটো রত্নের মতো জমা করিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহাই আজ একে একে সুরমার কাছে বাহির করিতে লাগিলেন।

সুরমা কহিল, “আহা, দাদামহাশয়ের মতো কি আর লোক আছে।” সুরমা ও উদয়াদিত্য বিভার ঘরে গেলেন।

তখন বিভা তাহার দাদামহাশয়ের পাকা চুল তুলিতেছে, ও তিনি বসিয়া গান গাহিতেছেন,
                               “ওরে, যেতে হবে, আর দেরি নাই,
                               পিছিয়ে পড়ে রবি কত, সঙ্গীরা তোর গেল সবাই।
                               আয় রে ভবের খেলা সেরে, আঁধার করে এসেছে রে,
                     (ওরে)   পিছন ফিরে বারে বারে কাহার পানে চাহিস রে ভাই।
                               খেলতে এল ভবের নাটে, নতুন লোকে নতুন খেলা,
                               হেথা হতে আয় রে সরে, নইলে তোরে মারবে ঢেলা,
                               নামিয়ে দে রে প্রাণের বোঝা, আর এক দেশে চল্‌ রে সোজা,
                     (সেথা)  নতুন করে বাঁধবি বাসা, নতুন খেলা খেলবি সে ঠাঁই।”

উদয়াদিত্যকে দেখিয়া বসন্ত রায় হাসিয়া কহিলেন, “দেখো ভাই, বিভা আমাকে ছাড়িতে চায় না। কী জানি আমাকে উহার কিসের আবশ্যক। এক কালে যে দুধ ছিল, বুড়া হইয়া সে ঘোল হইয়া উঠিয়াছে, তা বিভা দুধের সাধ ঘোলে মিটাইতে চায় কেন? আমি যাব শুনিয়া বিভা কাঁদে! এমন আর কখনো শুনিয়াছ? আমি ভাই, বিভার কান্না দেখিতে পারি না।” বলিয়া গাহিতে লাগিলেন,
                               “আমার যাবার সময় হল,
                               আমায় কেন রাখিস ধরে,
                               চোখের জলের বাঁধন দিয়ে
                               বাঁধিস নে আর মায়াডোরে।
                               ফুরিয়েছে জীবনের ছুটি,
                               ফিরিয়ে নে তোর নয়ন দুটি,
                               নাম ধরে আর ডাকসি নে ভাই,
                               যেতে হবে ত্বরা করে।”

“ঐ দেখো, ঐ দেখো বিভার রকম দেখো। দেখ্‌ বিভা, তুই যদি অমন করিয়া কাঁদিবি তো– ” বলিতে বলিতে বসন্ত রায়ের আর কথা বাহির হইল না। তিনি বিভাকে শাসন করিতে গিয়া নিজেকে আর সামলাইতে পারিলেন না, তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছিয়া হাসিয়া কহিলেন, “দাদা, ঐ দেখো ভাই, সুরমা কাঁদিতেছে। এই বেলা ইহার প্রতিবিধান করো; নহিলে আমি সত্য সত্যই থাকিয়া যাইব, তোমার জায়গাটি দখল করিয়া বসিব। ঐ দুই হাতে পাকা চুল তোলাইব, ঐ কানের কাছে এই ভাঙা দাঁতের পাটির মধ্য হইতে ফিসফিস করিব, আর কানের অত কাছে গিয়া আর যদি কোনো প্রকার অঘটন সংঘটন হয় তবে তাহার দায়ী আমি হইব না।”

বসন্ত রায় দেখিলেন, কেহ কোনো কথা কহিল না, তখন তিনি কাতর হইয়া তাঁহার সেতারটা তুলিয়া লইয়া ঝন্‌‍ঝন্‌ করিয়া বিষম বেগে বাজাইতে শুরু করিলেন। কিন্তু বিভার চোখের জল দেখিয়া তাঁহার সেতার বাজাইবার বড়োই ব্যাঘাত হইতে লাগিল, তাঁহার চোখ মাঝে মাঝে ঝাপসা হইয়া আসিতে লাগিল, মাঝে মাঝে বিভাকে এবং উপস্থিত সকলকে তিরস্কারচ্ছলে রাশ রাশ কথা