সোনার তরী

প্রকাণ্ড প্রলয়ে। পরক্ষণে মহা অপরাধীপ্রায়

পড়ে থাকে তটতলে স্তব্ধ হয়ে বিষণ্ন ব্যথায়

নিষণ্ন নিশ্চল — ধীরে ধীরে প্রভাত উঠিয়া এসে

শান্তদৃষ্টি চাহে তোমাপানে ; সন্ধ্যাসখী ভালোবেসে

স্নেহকরস্পর্শ দিয়ে সান্ত্বনা করিয়ে চুপেচুপে

চলে যায় তিমিরমন্দিরে ; রাত্রি শোনে বন্ধুরূপে

গুমরি ক্রন্দন তব রুদ্ধ অনুতাপে ফুলে ফুলে।

 

 

আমি পৃথিবীর শিশু বসে আছি তব উপকূলে,

শুনিতেছি ধ্বনি তব। ভাবিতেছি, বুঝা যায় যেন

কিছু কিছু মর্ম তার — বোবার ইঙ্গিতভাষা-হেন

আত্মীয়ের কাছে। মনে হয়, অন্তরের মাঝখানে

নাড়ীতে যে-রক্ত বহে, সেও যেন ওই ভাষা জানে,

আর কিছু শেখে নাই। মনে হয়, যেন মনে পড়ে

যখন বিলীনভাবে ছিনু ওই বিরাট জঠরে

অজাত ভুবনভ্রূণ-মাঝে, লক্ষকোটি বর্ষ ধ ' রে

ওই তব অবিশ্রাম কলতান অন্তরে অন্তরে

মুদ্রিত হইয়া গেছে ; সেই জন্মপূর্বের স্মরণ,

গর্ভস্থ পৃথিবী ' পরে সেই নিত্য জীবনস্পন্দন

তব মাতৃহৃদয়ের — অতি ক্ষীণ আভাসের মতো

জাগে যেন সমস্ত শিরায়, শুনি যবে নেত্র করি নত

বসি জনশূন্য তীরে ওই পুরাতন কলধ্বনি।

দিক্‌ হতে দিগন্তরে যুগ হতে যুগান্তর গণি

তখন আছিলে তুমি একাকিনী অখণ্ড অকূল

আত্মহারা, প্রথম গর্ভের মহা রহস্য বিপুল

না বুঝিয়া। দিবারাত্রি গূঢ় এক স্নেহব্যাকুলতা,

গর্ভিণীর পূর্বরাগ, অলক্ষিতে অপূর্ব মমতা,

অজ্ঞাত আকাঙ্ক্ষারাশি, নিঃসন্তান শূন্য বক্ষোদেশে

নিরন্তর উঠিত ব্যাকুলি। প্রতি প্রাতে উষা এসে

অনুমান করি যেত মহাসন্তানের জন্মদিন,

নক্ষত্র রহিত চাহি নিশি নিশি নিমেষবিহীন