বউ-ঠাকুরানীর হাট

বসন্ত রায়। তাড়াতাড়ি কহিলেন, “তবে কাজ নাই– কাজ নাই।” উভয়ে চলিলেন।

আবার কিছু দূর গিয়া কহিলেন, “একটু বিলম্ব করিলে কি চলে না?”

সীতারাম। না মহারাজ, তাহা হইলে বিপদ হইবে।

“দুর্গা বলো” বলিয়া বসন্ত রায় প্রাসাদের বাহির হইয়া গেলেন।

বসন্ত রায় যে আসিয়াছেন, তাহা উদয়াদিত্য জানেন না। বিভা তাঁহাকে বলে নাই। কেননা যখন উভয়ের দেখা হইবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না, তখন এ সংবাদ তাঁহার কষ্টের কারণ হইত। সন্ধ্যার পর বিদায় লইয়া বিভা কারাগার হইতে চলিয়া গিয়াছে। উদয়াদিত্য একটি প্রদীপ লইয়া একখানি সংস্কৃত গ্রন্থ পড়িতেছেন। জানালার ভিতর দিয়া বাতাস আসিতেছে, দীপের ক্ষীণ শিখা কাঁপিতেছে, অক্ষর ভালো দেখা যাইতেছে না। কীটপতঙ্গ আসিয়া দীপের উপর পড়িতেছে। এক-এক বার দীপ নিভো-নিভো হইতেছে। একবার বাতাস বেগে আসিল– দীপ নিবিয়া গেল। উদয়াদিত্য পুঁথি ঝাঁপিয়া তাঁহার খাটে গিয়া বসিলেন। একে একে কত কী ভাবনা আসিয়া পড়িল। বিভার কথা মনে আসিল। আজ বিভা কিছু দেরি করিয়া আসিয়াছিল, কিছু সকাল সকাল চলিয়া গিয়াছিল। আজ বিভাকে কিছু বিশেষ ম্লান দেখিয়াছিলেন; তাহাই লইয়া মনে মনে আলোচনা করিতেছিলেন। পৃথিবীতে যেন তাঁহার আর কেহ নাই। সমস্ত দিন বিভাকে ছাড়া আর কাহাকেও দেখিতে পান না। বিভাই তাঁহার একমাত্র আলোচ্য। বিভার প্রত্যেক হাসিটি প্রত্যেক কথাটি তাঁহার মনে সঞ্চিত হইতে থাকে। তৃষিত ব্যক্তি তাহার পানীয়ের প্রত্যেক বিন্দুটি পর্যন্ত যেমন উপভোগ করে, তেমনি বিভার প্রীতির অতি সামান্য চিহ্নটুকু পর্যন্ত তিনি প্রাণ-মনে উপভোগ করেন। আজ তাই এই বিজন ক্ষুদ্র অন্ধকার ঘরের মধ্যে একলা শুইয়া স্নেহের প্রতিমা বিভার ম্লান মুখখানি ভাবিতেছিলেন। সেই অন্ধকারে বসিয়া তাঁহার একবার মনে হইল, “বিভার কি ক্রমেই বিরক্তি ধরিতেছে? এই নিরানন্দ কারাগারের মধ্যে এক বিষণ্ন অন্ধকার মূর্তির সেবা করিতে আর কি তাহার ভালো লাগিতেছে না? আমাকে কি ক্রমেই সে তাহার সুখের বাধা তাহার সংসারপথের কন্টক বলিয়া দেখিবে? আজ দেরি করিয়া আসিয়াছে, কাল হয়তো আরো দেরি করিয়া আসিবে, তাহার পরে একদিন হয়তো সমস্ত দিন বসিয়া আছি কখন বিভা আসিবে– বিকাল হইল, সন্ধ্যা হইল– রাত্রি হইল, বিভা আর আসিল না।– তাহার পর হইতে আর হয়তো বিভা আসিবে না।” উদয়াদিত্যের মনে যতই এই কথা উদয় হইতে লাগিল, ততই তাঁহার মনটা হা হা করিতে লাগিল– তাঁহার কল্পনারাজ্যের চারিদিক কী ভয়ানক শূন্যময় দেখিতে লাগিলেন। একদিন আসিবে যেদিন বিভা তাঁহাকে স্নেহশূন্য নয়নে তাহার সুখের কন্টক বলিয়া দেখিবে– সেই অতিদূর কল্পনার আভাসমাত্র লাগিয়া তাঁহার হৃদয় একেবারে ব্যাকুল হইয়া উঠিল। একবার মনে করিতেছেন, “আমি কী ভয়ানক স্বার্থপর। আমি বিভাকে ভালোবাসি বলিয়া তাহার যে ঘোরতর শত্রুতা করিতেছি কোনো শত্রুও বোধ করি এমন পারে না।” বার বার করিয়া প্রতিজ্ঞা করিতেছেন আর বিভার উপর নির্ভর করিবেন না। কিন্তু যখনই কল্পনা করিতেন তিনি বিভাকে হারাইয়াছেন তখনই তাঁহার মনের সে বল চালিয়া যাইতেছে, তখনই তিনি অকূল পাথারে পড়িয়া যাইতেছেন– মরণাপন্ন মজ্জমান ব্যক্তির মতো বিভার কাল্পনিক মূর্তিকে আকুলভাবে আঁকড়িয়া ধরিতেছেন।

এমন সময়ে বহির্দেশে সহসা “আগুন আগুন” বলিয়া এক ঘোরতর কোলাহল উঠিল। উদয়াদিত্যের বুক কাঁপিয়া উঠিল। সহসা নানা কণ্ঠের নানাবিধ চীৎকার আকাশে উঠিল– বাহিরে শত লোকের দ্রুত পদশব্দ শুনা গেল। উদয়াদিত্য বুঝিলেন, প্রাসাদের কাছাকাছি কোথাও আগুন লাগিয়াছে। অনেকক্ষণ ধরিয়া গোলমাল চলিতে লাগিল– তাঁহার মন অত্যন্ত অধীর হইয়া উঠিল। সহসা দ্রুতবেগে তাঁহার কারাগারের দ্বার খুলিয়া গেল। কে একজন তাঁহার অন্ধকার গৃহে প্রবেশ করিল– তিনি চমকিয়া উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে ও?”