জিহ্বা আস্ফালন
অত্যন্ত উপকার হইতেছে। কাজেই ইহাদের বুক ক্রমেই ফুলিতে থাকে ও প্রাণ ক্রমেই সংকীর্ণ হইতে থাকে, বঙ্গসমাজ বা বঙ্গসাহিত্যের সর্বাঙ্গীণ বিকাশকে অত্যন্ত ভয় করেন। ইঁহারা চান বঙ্গসাহিত্য কেবলমাত্র দাঁত ও নখের চর্চা করিতে থাকুক আর কিছু নয়। ক্ষমতাভেদেও ও অবস্থাভেদে যে প্রত্যেকে স্ব স্ব উপযোগী কার্যে প্রবৃত্ত হইবে ও এইরূপে সমাজের অন্তর্নিহিত বিচিত্র শক্তি চারি দিক হইতে বিকশিত হইয়া উঠিবে তাহা তাঁহাদের অভিপ্রেত নহে। আজ কয়েক বৎসর ধরিয়া এই শ্রেণীর কতকগুলি সংকীর্ণদৃষ্টি সমালোচক কবিদিগকে কবিত্ব শিখাইয়া আসিতেছেন ও অবিরত বীররস ফরমাস করিতেছেন এবং অবশিষ্ট আটটি রসের মধ্যে কোনো একটি রসের ছিঁটাফোঁটা দেখিবামাত্র ননীর পুতুলি বঙ্গসমাজের স্বাস্থ্যভঙ্গের ভয়ে শশব্যস্ত হইয়া উঠিতেছেন! তাহার কতকটা ফল ফলিয়াছে, বীররসটা ফ্যাশান হইয়া পড়িয়াছে। গদ্য লেখক ও পদ্য লেখকগণ পালোয়ান সমালোচকদিগের চিৎকার বন্ধ করিয়া দিবার জন্য তাহাদের মুখে বীররসের টুকরা ফেলিয়া দিতেছেন। সকলেই বলিতেছে, উঠ, জাগো; বাংলায় ইংরাজিতে গদ্যে, পদ্যে, মিত্রাক্ষরে, অমিত্রাক্ষরে, হাটে ঘাটে, নাট্যশালায়, সভায়, ছেলে মেয়ে বুড়ো সকলেই বলিতেছে, উঠ, জাগো! সকলেই যে অকপট হৃদয়ে বলিতেছে বা কেহই যে বুঝিয়া বলিতেছে তাহা নহে। সকলেই বলিতেছে, 'আজ ঊনবিংশ শতাব্দী', ঊনবিংশ শতাব্দীটা যেন বঙ্গসমাজের বাবা স্বয়ং রোজগার করিয়া আনিয়াছে! 'ঊনবিংশ শতাব্দী' নামক একটা অনুবাদিত শব্দ বাঙালির মুখে শুনিলে অত্যন্ত হাসি পায়। যে বাঙালি দুই দিন বিলাতে থাকিয়া বিলাতকে home বলেন তিনিও ইহা অপেক্ষা হাস্যজনক কথা বলেন না! ঊনবিংশ শতাব্দী আমাদের কে? আঠারোটি শতাব্দী যাহাদিগকে ক্রমান্বয়ে মানুষ করিয়া আসিয়াছে, নিজের বিদ্যালয়ে পাঠাভ্যাস করাইয়াছে, তাহারাই ঊনবিংশ শতাব্দী লইয়া গর্ব করিতেছে। আর আমরা আজ দুদিন ইংরাজের সহিত আলাপ করিয়া এমনিভাবে কথাবার্তা আরম্ভ করিয়াছি যেন ঊনবিংশ শতাব্দীটা আমাদেরই! যেন ঊনবিংশ শতাব্দীটা অত্যন্ত সস্তা দামে বাংলা দেশে নিলাম হইয়া গিয়াছে, আর বঙ্গীয় বীরপুরুষ নামক জয়েন্ট স্টক্‌ কোম্পানি তাহা সমস্তটা কিনিয়া লইয়াছেন। ভাববিশেষ যখন সমাজে ফ্যাশান হইয়া যায় তখন এইরূপই ঘটে। তখন তাহার আনুষঙ্গিক কতকগুলা কথা মুখে মুখে চলিত হইয়া যায়, সে কথাগুলার যেন একটা অর্থ আছে এইরূপ ভ্রম হয়, কিন্তু জিজ্ঞসা করিলে কেহ তাহার অর্থ ভালো করিয়া বুঝাইয়া দিতে পারেন না। কৃত্রিমতা মাত্রেই মন্দ, তথাপি মতের কৃত্রিমতা সহ্য করা যায়, কিন্তু হৃদয়ের অনুভাবের কৃত্রিমতা একেবারে অসহ্য! আজকাল যেখানে যাহার তাহার মুখে 'ভারত মাতা' সম্বন্ধীয় গোটাকতক হৃদয়সম্পর্কশূন্য বাঁধি বোল শুনিতে পাওয়া যায়; তাহারা এমনিভাবে কথাগুলো ব্যবহার করে যেন সব কথার মানে তাহারা জানে, যেন তাহা তাহাদের প্রাণের ভাষা! কিন্তু ইহাতে তাহাদের দোষ নাই, যে-সকল সমালোচক দিবারাত্রি চেষ্টা করিয়া এত বড়ো একটি মহৎ ভাবকে ফ্যাশানের ঘৃণিত হীনত্বে পরিণত করিয়াছেন, হৃদয়জাত ভাবকে সস্তা করিবার জন্য কলে ফেলিয়া গড়িতে পরামর্শ দিয়াছেন, অবশেষে তাহা আবালবৃদ্ধবনিতার হাতে হাতে দোকানের কেনাবেচা দ্রব্যের মতো, রাংতা-মাখানো শব্দ-উৎপাদক চকচকে ভেঁপুর মতো করিয়া তুলিয়াছেন তাঁহারাই ইহার জন্য দায়ী। যে ভাব ও যে কথার অর্থ ভুলিয়া যাই, যাহারা আর হৃদয় হইতে উঠে না, কেবল মুখে মুখে বিরাজ করে, তাহারা মরিয়া যায় ও জীবন অভাবে ক্রমশই পচিয়া উঠিতে থাকে। দেশহিতৈষিতার বুলিগুলিরও সেই দশা ধরিবে। তুমি জিজ্ঞাসা করিতেছ, 'বঙ্গসাহিত্যে ও ছাইভস্মগুলা কেন?' আমি বলিতেছি, 'কী করা যায়! একদল মহা বীর আছেন, তাঁহারা বঙ্গসাহিত্যে অগ্নিকাণ্ড করিতে চান। সময় অসময় আবশ্যক অনাবশ্যক কিছু না মানিয়া দিনরাত্রি আগুন জ্বালাইয়া রাখিতে চান, কাজেই বিস্তর ছাই ভস্ম জমিয়াছে।'

এইখানে একটা গল্প বলি। একটা পাড়ায় পাঁচ-সাতজন মাতাল বাস করিত। তাহারা একত্রে মদ্যপান করিয়া অত্যন্ত গোলমাল করিত। পাড়ার লোকেরা একদিন তাহাদিগকে ধরিয়া অত্যন্ত প্রহার দিল। সেই প্রহারের স্মৃতিতে পাঁচ-সাত দিন তাহাদের মদ খাওয়া স্থগিত রহিল, অবশেষে আর থাকিতে না পারিয়া তাহারা প্রতিজ্ঞা করিল আজ মদ খাইয়া আর কোনো প্রকার গোল করিব না। উত্তমরূপে দরজা বন্ধ করিয়া তাহারা নিঃশব্দে মদ্যপান আরম্ভ করিল। সকলেরই যখন মাথায় কিছু কিছু মদ চড়িয়াছে, তখন সহসা