সমাজ সংস্কার ও কুসংস্কার
তখনই সে বোস হইল, ইহাকে 'প্রকৃতিস্থ' লোকে স্বাতন্ত্র্যের অভাব বলে না তো কী বলে? বিবাহের পর স্ত্রীর অনুসারে স্বামীর নামেরও পরিবর্তন হয় না কেন? স্বামীরা কর্তা বলিয়া। যাহা হউক, স্ত্রী স্বাতন্ত্র্য ভালো কি মন্দ সে কথা হইতেছে না, কথাটা এই যে যাঁহারা স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যের পাছে একটুখানি খর্বতা হয় বলিয়া সম্প্রদান প্রথা উঠাইয়া দিতে চান তাঁহারা কোন্‌ মুখে স্ত্রীলোকের পদবী পরিবর্তন প্রথা গ্রহণ করিতে পারেন?

প্রথম পক্ষ। তবে, যদি বল পরিচয়ের সুবিধার জন্য স্ত্রীলোকদের নামের সহিত পদবী গ্রহণ ও বিবাহ হইলে তাহার পরিবর্তন সমাজের বর্তমান অবস্থায় আবশ্যক করে, তবে তাহার বিরুদ্ধে বক্তব্য এই যে, ঘোষ বা বোস বলিলে আমাদের দেশে পরিচয়ের বিশেষ কী এমন সুবিধা হইল? আমাদের দেশের ঘোষ বোস প্রভৃতি উপাধি পরিবার-বিশেষের নাম নহে, বিস্তৃত শ্রেণীবিশেষের উপাধি, সুতরাং ইহাতে ব্যক্তিবিশেষগত পরিচয়ের কোনো সুবিধা হইল না।

দ্বিতীয় পক্ষ। পরিচয়ের সুবিধার জন্যই যে এই প্রথা প্রচলিত হইয়াছে সে কথা লেখিকা কোথা হইতে সংগ্রহ করিলেন? আমি তো মনে করি, দেবী ও দাসীর প্রভেদ উঠাইয়া দিবার জন্যই এই প্রথা অবলম্বন করিতে হইয়াছে। এককালে শূদ্রেরা দাসত্ব করিত, তাই বলিয়া যখন দাসত্ব করে না তখনও যে নামের সহিত সেই দাসত্বের স্মৃতি যত্নপূর্বক পুষিয়া রাখিতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। দ্বিতীয়ত, এখন জাতিভেদ উঠিয়া গিয়া অসবর্ণ বিবাহ হইতেছে; একজন ব্রাহ্মণকন্যা শূদ্রপত্নী হইলে তিনি আপনাকে দেবী বলিবেন, না দাসী বলিবেন? এরূপ অবস্থায় তিনি কী করিবেন?

তৃতীয় পক্ষ। স্ত্রীলোকের নামের সম্বন্ধে শ্রীমতী অনামিকা একটি ভুল বুঝিয়াছেন দেখিতেছি। দেবী জ্ঞানদানন্দিনী স্ত্রীলোকদিগের নামের শেষে দেবী দাসী যোগ করা লইয়া কিছুই বলেন নাই, সে বিষয়ে তাঁহার কী মত তাহা জানিও না। তিনি কেবল বলিয়াছেন স্ত্রীলোকদের নামের সহিত বংশের পদবী যোগ করা, কানেও খারাপ শুনায় বটে আবার তাহাতে পরিচয়েরও কোনো সুবিধা হয় না। সুতরাং,এ প্রথাটি ভালো নয়। শ্রীমতী-- যে বলিতেছেন নামের সঙ্গে দেবী দাসীর প্রভেদ থাকা ভালো নয়, সে বিষয়ে আমারও তাঁহার সহিত কোনো বিবাদ নাই, কিন্তু স্ত্রীলোকের নামের সহিত বংশের পদবী যোগ করা যে ভালো এ কথার সহিত পূর্বোক্ত কথাটার বিশেষ যোগ কোথায়। একটা ভালো নয় বটে, কিন্তু আর-একটা যে তাই বলিয়া ভালো তাহা কী করিয়া বলিব! আর শ্রীমতী-- যে পরিচয়ের সুবিধার কথাটা একেবারে উড়াইয়া দিয়াছেন, সেটা ভালো করেন নাই। জিজ্ঞাসা করি, নামের সৃষ্টি কিসের জন্য? কেবলমাত্র পরিচয়ের জন্য, উহার আর কোনোই উদ্দেশ্য নাই। যদি সে উদ্দেশ্য উপেক্ষা কর তবে নাম রাখিবার কোনো দরকার নাই। জাতিভেদের উপর আমাদের সমাজ-ব্যবহার অনেকটা নির্ভর করে, সুতরাং সামাজিকতার অনুরোধে দাসী ও দেবীর ভিন্ন পরিচয় পাওয়া আমাদের দেশে নিতান্ত আবশ্যক। যাঁহাদের সে অনুরোধ নাই, যাঁহারা জাতিভেদ মানেন না, তাঁহাদের আর দেবী দাসী বলিয়া পরিচয় দিবার দরকার নাই বটে, কিন্তু তাঁহারা বসু বা বাঁড়ুয্যে বলিয়াই বা পরিচয় দেন কীরূপে? কারণ 'বসু' ব্যক্তিবিশেষগত পরিচয় নয়, পরিবারবিশেষগত পরিচয় নয়, উহা জাতিবিশেষগত পরিচয়। যাঁহারা বলেন 'আমি বসু' তাঁহারা বলেন, 'আমি কায়স্থজাতির শ্রেণীবিশেষভুক্ত ব্যক্তি।' বসু বলিতে আর কিছুই বুঝায় না। সুতরাং সেই তো তাঁহারা জাতিভেদের পরিচয় দিলেন। সেই তো তাঁহারা ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ জাতির প্রভেদ স্বীকার করিলেন। আমাদের দেশের জাতিভেদ শাস্ত্র অনুসারে নির্দিষ্ট অতএব তুমি যদি একবার জাতিভেদ স্বীকার কর, তবে শাস্ত্র অনুসারে ইহাও স্বীকার করিতে হইবে যে, ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ জাতি ও শূদ্র অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট জাতি, এতটা পর্যন্তই যদি হইল তবে আর দেবী দাসী হইতে বেশি দূরে রহিল কই? তোমাদের কাজে ও কথায় মিল করিতে হইলে দেবী দাসীও ছাড়িতে হয়, ঘোষ বোসও ছাড়িতে হয়। হয়, কেবলমাত্র নামের পূর্বার্ধ রাখিয়া দাও, নয় রমণীপরিচয়সূচক এমন একটি নূতন সাধারণ শব্দ প্রচলিত করিয়া নামের শেষে যোগ করো যাহাতে জাতিভেদের অথবা শ্রেষ্ঠ- নিকৃষ্টত্বের কোনো উল্লেখ না থাকে। বোধ করি, মহারাষ্ট্রীয়দিগের 'বাই' শব্দ কতকটা এইরূপ। প্রতিবাদে যতগুলি কথা বলা