চণ্ডিদাস ও বিদ্যাপতি

খাইতে সোয়াস্তি নাই, নাহি টুটে ভুক –

কে মোর ব্যথিত আছে, কারে কব দুখ!

রাধার এই উক্তির মধ্যে কত কথাই অব্যক্ত আছে। যেখানে রাধা বলিতেছেন –

অনুক্ষণ গৃহে মোরে গঞ্জয়ে সকলে,

নিচয় জানিও মুঞি ভখিমু গরলে।

এই দুই ছত্রের অর্থ এই, “আমাকে গৃহে সকলে গঞ্জনা করে, অতএব”–সে ‘অতএব’ কি, তাহা কি কাহাকেও বলিতে হইবে? সেই ‘অতএব’ যদি পূর্ণ না হয় তবে রাধা বিষ খাইবে। “কে মোর ব্যথিত আছে, কারে কব দুখ? “ রাধা শ্যামের মুখ হইতে শুনিতে চায়- আমি তোমার ব্যথিত, আমি তোমার দুঃখ শুনিব! রাধা শ্যামকে কহিল না যে, তুমি আমার দুঃখে দুঃখ পাও, তুমি আমার ব্যথার ব্যথী হও, সে শুধু শ্যামের মুখ চাহিয়া কহিল– “কে মোর ব্যথিত আছে, কারে কব দুখ?”

চণ্ডিদাসের কথা এই যে, প্রেমে দুঃখ আছে বলিয়া প্রেম ত্যাগ করিবার নহে। প্রেমের যা কিছু সুখ সমস্ত দুঃখের যন্ত্রে নিংড়াইয়া বাহির করিতে হয়।–

যেন মলয়জ ঘষিতে শীতল,

      অধিক সৌরভময়,

শ্যাম বঁধুয়ার পিরীতি ঐছন,

      দ্বিজ চণ্ডিদাস কয়।

দুঃখের পাষাণে ঘর্ষণ করিয়া প্রেমের সৌরভ বাহির করিতে হয়। যতই ঘর্ষিত হইবে, ততই সৌরভ বাহির হইবে। চণ্ডিদাস কহেন প্রেম কঠোর সাধনা। কঠোর দুঃখের তপস্যায় প্রেমের স্বর্গীয় ভাব প্রস্ফুটিত হইয়া উঠে। –

পিরীতি পিরীতি সব জন কহে,

      পিরীতি সহজ কথা?

বিরিখের ফল নহে ত পিরীতি,

      নাহি মিলে যথা তথা।

পিরীতি অন্তরে, পিরীতি মন্তরে,

      পিরীতি সাধিল যে

পিরীতি রতন লভিল সে জন–

      বড় ভাগ্যবান সে।

পিরীতি লাগিয়া আপনা ভুলিয়া

      পরেতে মিশিতে পারে,

পরকে আপন করিতে পারিলে

      পিরীতি মিলয়ে তারে।

পিরীতি-সাধন বড়ই কঠিন

      কহে দ্বিজ চণ্ডিদাস,

দুই ঘুচাইয়া এক অঙ্গ হও

      থাকিলে পিরীতি-আশ।