এক-চোখো সংস্কার
বিবাহভার থাক্‌। কিন্তু এই পরাধীন বিবাহপ্রথা রক্ষা করিতে হইলে তাহার সঙ্গে সঙ্গে আবার আরো অনেকগুলি আনুষঙ্গিক প্রথা রক্ষা করিতে হয়। যেমন বাল্যবিবাহ ও অবরোধপ্রথা। যদি স্ত্রীলোকেরা অন্তঃপুরের বহির্দ্দেশে বিচরণ করিতে পায়, ও অধিক বয়সে বিবাহপ্রথা প্রচলিত হয়, তবে অসবর্ণ বিবাহ আরম্ভ হইবেই। যখন যৌবনকালে কুমার কুমারী-যুগলের পরস্পরের প্রতি অনুরাগ জন্মাইবে, তখন কি পিতামাতার ও চিরন্তন প্রথার নীরস আদেশ তাহারা মান্য করিবে? তাহা ব্যতীতও বাল্যবিবাহের আর একটি অর্থ আছে। বালককাল হইতে দম্পতির একত্রে বর্দ্ধন, একত্রে অবস্থান হইলে, উভয়ে এক রকম মিশ খাইয়া যায়, বনিয়া যায়। কিন্তু যখন পাত্র ও পাত্রী উভয়ে বয়স্ক, উভয়েরই যখন চরিত্র সংগঠিত ও মতামত স্থিরীকৃত হইয়া গিয়াছে ও কচি-অবস্থার নমনীয়তা চলিয়া গিয়াছে ও পাকা-অবস্থার দৃঢ়তা জন্মিয়াছে, তখন অমন দুই ব্যক্তিকে অনুরাগ ব্যতীত আর কিছুতেই জুড়িতে পারে না – না বাসসামীপ্য, না বিবাহের মন্ত্র। তাহাদের যতই বলপূর্ব্বক একত্র করিতে চেষ্টা করিবে, ততই তাহারা দ্বিগুণ বলে তফাৎ হইতে থাকিবে। অনুরাগ করা তাহাদের পক্ষে কর্ত্তব্য কার্য্য বলিয়াই অনুরাগ করা তাহাদের পক্ষে দ্বিগুণ দুঃসাধ্য হইয়া পড়িবে। অতএব যদি অসবর্ণ বিবাহ না দেও তবে পূর্ব্বরাগমূলক বিবাহ দিও না, বাল্যবিবাহ প্রচলিত থাক্‌, অবরোধপ্রথা উঠাইও না। তুমি যে মনে করিতেছ, ‘সুবিধামত আমি সমাজ হইতে লোকাচারের একটি মাত্র ইঁট খসাইয়া লইব, আর অধিক নয়’, তোমার কি ভ্রম! ঐ একটি ইঁট খসিলে কতগুলি ইঁট খসিবে ও প্রাচীরে কতখানি ছিদ্র হইবে তাহা তুমি জান না।

অতএব দেখা যাইতেছে দুই দল লোক সমাজসংস্কার করে। এক – যাহারা লোকাচারকে একেবারে মূল হইতে উৎপাটন করে, আর – যাহা লোকাচারের একটি একটি করিয়া শিকড় কাটিয়া দেয় ও অবশেষে কপালে করাঘাত করিয়া বলে, ‘এ কি হইল। গাছ শুকাইল কেন? ‘ ইহাদের উভয়েরই আবশ্যক। প্রথম দল যখন কোন একটা লোকাচার আমূলতঃ বিনাশ করিতে চায়, তখন সমাজ কোমর বাঁধিয়া রুখিয়া দাঁড়ায়। কিন্তু তাহাই বলিয়া যে সংস্কারকদের সমস্ত প্রয়াস বিফল হয় তাহা নহে। তাহার একটা ফল থাকিয়া যায়। মনে কর যেখানে অবরোধপ্রথা একাবারে তুচ্ছ করিয়া পাঁচ জন সংস্কারক তাঁহাদের পত্নীদিগকে গাড়ি চড়াইয়া রাস্তা দিয়া লইয়া যান, সেখানে দশ জন স্ত্রীলোক পাল্কী চড়িয়া যাইবার সময় দরজা খুলিয়া রাখিলেও তাঁহাদের কেহ নিন্দা করে না। কেবল মাত্র যে তাঁহাদের নিন্দা করে না, তাহা নহে; তাঁহাদের লক্ষ্য করিয়া সকলে বলাবলি করে, “হাঁ, এ ত বেশ! ইহাতে ত আমাদের কোন আপত্তি নাই! কিন্তু মেয়ে মানুষে গাড়ি চড়িবে সে কি ভয়ানক! “ আপত্তি যে নাই, তাহার কারণ, আর পাঁচ জন গাড়ি চড়ে। নহিলে বিষম আপত্তি হইত। সমাজ যখন দেখে দশ জন লোক হোটেলে গিয়া খানা খাইতেছে, তখন যে বিশ জন লোক ব্রাক্ষ্মণকে দিয়া মুরগী রাঁধাইয়া খায়, তাহাদিগকে দ্বিগুণ আদরে বুকে তুলিয়া লয়। ইহাই দেখিয়া অদূরদর্শীগণ আমূল-সংস্কারকদিগকে বলিয়া থাকে, ‘দেখ দেখি, তোমরাও যদি এইরূপ অল্পে অল্পে আরম্ভ করিতে, সমাজ তোমাদেরও কোন নিন্দা করিত না।’

এক কালে যে লোকাচারের প্রাচীরটি আশ্রয়স্বরূপ ছিল, আর এক কালে তাহাই কারাগার হইয়া দাঁড়ায়। এক দল কামান লইয়া বলে, ‘ভাঙিয়া ফেলিব।’ আর-এক দল রাজমিস্ত্রির যন্ত্রাদি আনিয়া বলে, ‘না, ভাঙিয়া কাজ নাই, গোটাকতক খিড়্‌কির দরজা তৈরি করা যাক।’ অমনি সমাজ হাঁপ ছাড়িয়া বলে, ‘হাঁ, এ বেশ কথা! ‘ এই রূপে আমাদের অসংখ্য লোকাচারের প্রাচীরে খিড়্‌কির দরজা বসিয়াছে। প্রত্যহ একটি একটি করিয়া বাড়িতেছে; অবশেষে যখন দেখিবে তাহার নিয়মসমূহে এত খিড়্‌কির দরজা হইয়াছে যে তাহার প্রাচীরত্ব আর রক্ষা হয় না, তখন সমস্তটা ভাঙ্গিয়া ফেলিতে আর আপত্তি করিবে না, এমন-কি, তখন ভাঙ্গিয়া ফেলাও আর আবশ্যক হইবে না। এইরূপে এক-চোখো সংস্কারকগণ নিজের উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে যতটা সমাজসংস্কার করেন, এমন অল্প সংস্কারকই করিয়া থাকেন। ইঁহারা রক্ষণশীলদলভুক্ত হইয়াও উৎপাটনশীলদিগকে সাহায্য করেন।