প্রদেশিক সভার উদ‍্‌বোধন
বিশেষ বিশেষ হেতুগত। আমরা এ দেশে যেমন করি তাহারাও সেইরূপ গবর্মেন্টের ত্রুটি অবলম্বন করিয়া অভিযোগ করে। যখন এমন কোনো আইন পাস হয় যাহাকে আমরা মন্দ জ্ঞান করি তখন তাহার বিরুদ্ধে আপত্তি জানাই, কিন্তু তাই বলিয়া রাজার সহিত প্রজাসম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করি না। সেইরূপ—যদি ভারতবাসীর অন্তঃকরণ আমি ঠিক বুঝিয়া থাকি—তাহারাও বিশেষ ধারা অথবা বিশেষ আইনের প্রচলন সম্বন্ধেই আপত্তি প্রকাশ করে—কিন্তু ব্রিটিশ শাসন যে ভারতের পক্ষে হিতকারী তাহা অস্বীকার করিবার কোনো লক্ষণ কোথাও দেখা যায় না, এবং যখন একটি উদ্‌ধৃত রচনায় দখিলাম লেখক বলিতেছেন, যে, বর্তমান অবস্থায়—ব্রিটিশ রাজ্যের ধ্বংস নহে—প্রত্যুত তাহার স্থায়িত্বই ভারতবর্ষের সকল আশার আশ্রয়স্থান—তখন আমি বিস্ময় এবং বিস্ময়ের সহিত আনন্দ উপভোগ করিয়াছি। ভালো, যখন এত দূরই অগ্রসর হইয়াছ, অথচ অনিবার্য অবস্থাবৈষম্যবশত যখন সমস্ত ভরতবর্ষে স্বায়ত্ত রাজ্যবিধির মূল সূত্রপাত করিতেও যথেষ্ট দ্বিধা উপস্থিত হয়, তখন অন্তত এটুকু অঙ্গীকার করিতেই হইবে যে, যাহা আমারা দান করিব তাহা আমরা প্রত্যাখান করিব না; সুতরাং আমাদের স্বরাজ্যতন্ত্রে আমরা যে সর্বোচ্চ উপকারগুলি ভোগ করি, অর্থাৎ প্রাজাগণ যে-সকল রাজকার্যবিধিতে ঔৎসুক্যবান তাহাকে প্রকাশ্যতা দান করা, এবং অন্যায় ও ভ্রম হইতে রক্ষা পাইবার জন্য বিচার ও আলোচনার উদ্দেশে তাহকে যথেষ্ট সময় দেওয়া—সেই অধিকার যখন আমরা ভারতবর্ষকে দান করিয়াছি; তখন বর্তমান ঘটনায় ভারতবর্ষীয় গবর্মেন্টের নিরতিশয় শঠকারিতা ও একান্ত গোপনতা পরম দুঃখের বিষয় হইয়াছে; বিশেষত যখন এই ত্বরাতিশয্য ও মন্ত্রগুপ্তি কেবলমাত্র কোনো আংশিক সংশোধন ও পরিবর্তন-উদ্দেশে নহে, পরন্তু দেশীয় সংবাদপত্র সম্বন্ধে একটি গুরুতর আইনস্থাপনা উপলক্ষ্যে।–

কনফারেন্সের গত অধিবেশনের পর আমরা আমাদের দেশের প্রবীণা মহানারীর মৃত্যুশোক অনুভব করিয়াছি—সেই কাশিমবাজারের রানী স্বর্ণময়ী যাঁহার দেশবিশ্রুত সদ্‌গুণ, ভারতবর্ষেরই সর্বসন্মত বিশেষ সদ্‌গুণ, দয়া। তাঁহার সেই দয়ায় প্রাচ্য দেশের মুক্তহস্ত বদান্যতা এবং প্রতীচ্যভাগের অর্থনৈতিক দূরদর্শিতা একত্রে মিশ্রিত হইয়াছিল।

এক্ষণে আমাদের এই সভার প্রথম কর্তব্য, বাংলার নূতন শাসনকর্তাকে স্বাগত সম্ভাষণ। তিনি তাঁহার রাজাসনে পদক্ষেপমাত্রেই আমাদের হৃদয় অধিকার করিয়াছেন। প্রজাপালনর জন্য সার জন্ বুড্‌বর্ন যে সর্বপ্রকার ত্যাগস্বীকারে উন্মুখ ইতিমধ্যে তিনি তাহার প্রমান দিয়াছেন, গুরুতর সংকটের রাজনীতিকে তিনি প্রজাদের প্রার্থনার অনুকূল করিয়াছেন। তাঁহার মন্ত্রগৃহের আসনে বসিয়া তিনি অঙ্গীকার করিয়াছেন যে, শিল্পশিক্ষাপ্রাপ্ত দেশীয় লোকদিগকে সাহায্য করিবার জন্য তিনি প্রস্তুত এবং তিনি রাষ্ট্রীয় ব্যয় সংক্ষেপের উপায় উদ্‌ভাবনের জন্য মন্ত্রসভার বেসরকারি মন্ত্রীগণকে বিশেষরূপে অনুরোধ করিয়াছেন। এইরূপে সার জন বাংলা দেশের ভবিষ্যৎকে আশার আলোকে উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছেন।

বৎসরটি দুর্দৈবের বৎসর চলিতেছে। ভূমিকম্পের আন্দোলনের মধ্যে গত কনফারেন্সের অধিবেশন সমাপ্ত হইয়াছিল। বঙ্গদেশের গাত্র হইতে দৈবনিগ্রহের ক্ষতচিহ্নগুলি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত না হইতেই পরে পরে দুর্ভিক্ষে এবং মারীর আবির্ভাব হইল। বিধাতার বিধানে অশুভ হইতেও শুভ ফল উৎপন্ন হয় গত দুর্ভিক্ষে তাহার পরিচয় পাওয়া গিয়াছে। সেই অন্নাভাবের দিন বিপন্ন ভারতের প্রতি জগতের সর্বত্র হইতেই করুণা বর্ষিত হইয়াছে। পৃথিবীর বৃহৎ জাতির সহিত যে আমাদের এক বন্ধন আছে তাহা তাঁহারা এই উপলক্ষে স্বীকার করিয়াছেন এবং আমরাও তাহা হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিতে পারিয়াছি।

কিন্তু প্লেগে যেন কতকটা তাহার বিপরীত ফল ফলিয়াছে; ইহাতে দুই জাতির হৃদয়বন্ধনে যেন কঠোর আঘাত করিয়াছে। রাজা-প্রজার পরস্পর বুঝাপড়ার অভাব হওয়াই তাহার মূল এবং শাসিত ও শাসনকর্তার মধ্যে অবাধ বার্তাবহনের অসম্পূর্ণতাই