রাজর্ষি

তৎক্ষণাৎ পুরোহিত গৃহে প্রবেশ করিলেন। পুরোহিতকে দেখিয়াই নক্ষত্ররায়ের ভ্রূকুটি কোথায় মিলাইয়া গেল, তাঁহার সম্পূর্ণ ভাবান্তর উপস্থিত হইল। তাঁহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল, কপালে ঘর্ম দেখা দিল। সাহানা-গান, সারঙ্গ ও মৃদঙ্গ সহসা বন্ধ হইল; কেবল বিড়ালের মিউ মিউ ধ্বনি নিস্তব্ধ ঘরে দ্বিগুণ জাগিয়া উঠিল!

এ রঘুপতিই বটে। তাহার আর সন্দেহ নাই। দীর্ঘ, শীর্ণ, তেজস্বী, বহুদিনের ক্ষুধিত কুকুরের মতো চক্ষু দুটো জ্বলিতেছে। ধুলায় পরিপূর্ণ দুই পা তিনি কিংখাব মছলন্দের উপর স্থাপন করিয়া মাথা তুলিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “নক্ষত্ররায়!”

নক্ষত্ররায় চুপ করিয়া রহিলেন।

রঘুপতি বলিলেন, “তুমি রঘুপতিকে ডাকিয়াছ। আমি আসিয়াছি।”

নক্ষত্ররায় অস্পষ্টস্বরে কহিলেন, “ঠাকুর– ঠাকুর!”

রঘুপতি কহিলেন, “উঠিয়া এস।”

নক্ষত্ররায় ধীরে ধীরে সভা হইতে উঠিয়া গেলেন। বিড়ালের বিয়ে, সাহানা এবং সারঙ্গ একেবারে বন্ধ হইল।


ষড়্‌‍বিংশ পরিচ্ছেদ

রঘুপতি জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ-সব কী হইতেছিল?”

নক্ষত্ররায় মাথা চুলকাইয়া কহিলেন, “নাচ হইতেছিল।”

রঘুপতি ঘৃণায় কুঞ্চিত হইয়া কহিলেন, “ছি ছি!”

নক্ষত্র অপরাধীর ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিলেন।

রঘুপতি কহিলেন, “কাল এখান হইতে যাত্রা করিতে হইবে। তাহার উদ্‌‍যোগ করো।”

নক্ষত্ররায় কহিলেন, “কোথায় যাইতে হইবে?”

রঘুপতি। সে কথা পরে হইবে। আপাতত আমার সঙ্গে বাহির হইয়া পড়ো।

নক্ষত্ররায় কহিলেন, “আমি এখানে বেশ আছি।”

রঘুপতি। বেশ আছি! তুমি রাজবংশে জন্মিয়াছ, তোমার পূর্বপুরুষেরা সকলে রাজত্ব করিয়া আসিয়াছেন। তুমি কিনা আজ এই বনগাঁয়ে শেয়াল রাজা হইয়া বসিয়াছ আর বলিতেছ “বেশ আছি”!

রঘুপতি তীব্র বাক্যে ও তীক্ষ্ণ কটাক্ষে প্রমাণ করিয়া দিলেন যে, নক্ষত্ররায় ভালো নাই। নক্ষত্ররায়ও রঘুপতির মুখের তেজে কতকটা সেইরকমই বুঝিলেন। তিনি বলিলেন, “বেশ আর কী এমনি আছি! কিন্তু আর কী করিব? উপায় কী আছে?”

রঘুপতি। উপায় ঢের আছে– উপায়ের অভাব নাই। আমি তোমাকে উপায় দেখাইয়া দিব, তুমি আমার সঙ্গে চলো।

নক্ষত্ররায়। একবার দেওয়ানজিকে জিজ্ঞাসা করি।

রঘুপতি। না।

নক্ষত্ররায়। আমার এই-সব জিনিসপত্র–

রঘুপতি। কিছু আবশ্যক নাই।

নক্ষত্ররায়। লোকজন–

রঘুপতি। দরকার নাই।