ল্যাবরেটরি
১৩

ড্রয়িংরুমে সোফায় পা দুটো তুলে কুশনে হেলান দিয়ে নীলা, মেঝের উপরে নীলার পায়ের কাছে ঠেস দিয়ে বসে আছে রেবতী, হাতে রয়েছে লেখন-ভরা ফুলস্ক্যাপ।

রেবতী মাথা নেড়ে বললে, “ভাষায় কেমন যেন বেশি রঙ ফলানো হয়েছে, এতটা বাড়িয়ে-বলা লেখা পড়তে লজ্জা করবে আমার।”

“ভাষার তুমি মস্ত সমজদার কিনা। এ তো কেমিষ্ট্রি ফরমুলা নয়, খুঁত খুঁত কোরো না, মুখস্থ করে যাও। জান এটা লিখেছেন আমাদের সাহিত্যিক প্রমদারঞ্জনবাবু? ”

“ঐ-সব মস্ত মস্ত সেণ্টেন্স আর বড়ো বড়ো শব্দগুলো মুখস্থ করা আমার পক্ষে ভারি শক্ত হবে।”

“ভারি তো শক্ত। তোমার কানের কাছে আউড়ে আউড়ে আমার তো সমস্তটা মুখস্থ হয়ে গেছে— ‘আমার জীবনের সর্বোত্তম শুভ মুহূর্তে জাগানী সভা আমাকে যে অমরাবতীর মন্দারমাল্যে সমলংকৃত করিলেন’— গ্র্যাণ্ড! তোমার ভয় নেই আমি তো তোমার কাছেই থাকব, আস্তে আস্তে তোমাকে বলে দেব।”

“আমি বাংলাসাহিত্য ভালো জানি নে কিন্তু আমার কেমন মনে হচ্ছে, সমস্ত লেখাটা যেন আমাকে ঠাট্টা করছে। ইংরেজিতে যদি বলতে দাও কত সহজ হয়। Dear friends, allow me to offer you my heartiest thanks for the honour you have conferred upon me on behalf of the Jagani Club—the great Awakener ইত্যাদি। এমন দুটো সেণ্টেন্স বললেই বাস্‌—”

“সে হচ্ছে না, তোমার মুখে বাংলা যে খুব মজার শোনাবে— ঐ যেখানটাতে আছে— ‘হে বাংলাদেশের তরুণসম্প্রদায়, হে স্বাতন্ত্র্যসজ্ঞালনরথের সারথি, হে ছিন্ন শৃঙ্খলপরিকীর্ণ পথের অগ্রণীবৃন্দ’— যাই বল ইংরেজিতে এ কি হবার জো আছে। তোমার মতো বিজ্ঞানবিশারদের মুখে শুনলে তরুণ বাংলা সাপের মতো ফণা দুলিয়ে নাচবে। এখনো সময় আছে, আমি পড়িয়ে নিচ্ছি।”

গুরুভার দীর্ঘ দেহকে সিঁড়ির উপর দিয়ে সশব্দে বহন করে সাহেবী পোশাকে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ব্রজেন্দ্র হালদার মচ্‌মচ্‌ শব্দে এসে উপস্থিত। বললে, “নাঃ এ অসহ্য, যখনই আসি তখনই নীলাকে দখল করে বসে আছ। কাজ নেই , কর্ম নেই, নীলিকে তফাত করে রেখেছ আমাদের কাছ থেকে কাঁটাগাছের বেড়ার মতো।”

রেবতী সংকুচিত হয়ে বললে, “আজ আমার একটু বিশেষ কাজ আছে তাই—”

“কাজ তো আছে, সেই ভরসাতেই তো এসেছিলুন; আজ তুমি মেম্বরদের নেমন্তন্ন করেছ, ব্যস্ত থাকবে মনে করে আপিসে যাবার আগে আধ ঘণ্টাটাক সময় করে নিয়ে তাড়াতাড়ি এসেছি। এসেই শুনেছি এখানেই উনি পড়েছেন কাজে বাঁধা। আশ্চর্য! কাজ না থাকলে এইখানেই ওঁর ছুটি, আবার কাজ থাকলে এইখানেই ওঁর কাজ। এমন নাছোড়বান্দার সঙ্গে আমরা কেজো লোকেরা পাল্লা দিই কী ক’রে। নীলি, is it fair।”

নীলা বললে, “ডক্টর ভট্‌চাজের দোষ হচ্ছে, উনি আসল কথাটা জোর করে বলতে পারেন না। উনি কাজ আছে বলে এসেছেন এটা বাজে কথা; না এসে থাকতে পারেন না বলেই এসেছেন, এটাই একটা শোনবার মতো কথা এবং সত্যি কথা। আমার সমস্ত সময় উনি দখল করেছেন ওঁর জেদের জোরে। এই তো ওঁর পৌরুষ। তোমাদের সবাইকে ঐ বাঙালের কাছে হার মানতে হল।”

“আচ্ছা ভালো, তা হলে আমাদেরও পৌরুষ চালাতে হবে। এখন থেকে জাগানীক্লাব-মেম্বররা নারীহরণের চর্চা শুরু করবে। জেগে উঠবে পৌরাণিক যুগ।”