সে

কী করি, ছবি - আঁকা বন্ধ করতে হল।

সে শুরু করলে —

ভাবো শ্রীকান্ত নরকান্তকারীরে,

নিতান্ত কৃতান্ত - ভয়ান্ত হবে ভবে।

আমার মুখের ভাব দেখে তার কী সন্দেহ হল জানি নে ; জিগেস করলে, কেমন লাগছে।

আমি বললুম, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তোমাকে গলা সাধতে হবে লোকালয় থেকে দূরে বসে। তার পরে বুঝে নেবেন চিত্রগুপ্ত, যদি সইতে পারেন।

সে বললে, পুপেদিদিও হিন্দুস্থানি ওস্তাদের কাছে গান শেখে, সেইখানে আমাকে বসিয়ে দিলে কেমন হয়।

আমি বললুম, পুপেদিদিকে যদি রাজি করাতে পার তা হলে কথা নেই।

সে বললে, পুপেদিদিকে আমি বড়ো ভয় করি।

এই পর্যন্ত শুনে আমার শ্রোতা পুপেদিদি খুব হেসে উঠল। তাকে কেউ ভয় করে, এতে সে ভারি খুশি। যেমন খুশি হয় জগতের দোর্দণ্ডপ্রতাপের দল।

দয়াময়ী আশ্বাস দিয়ে বললে, ভয় নেই, আমি তাকে কিছু বলব না।

আমি বললুম, তোমাকে ভয় কে না করে! দুবেলা দু বাটি করে দুধ খাও — গায়ে কী রকম জোর! মনে আছে তো, তোমার হাতে লাঠি দেখে সেই বাঘটা লেজ গুটিয়ে একেবারে নুটুপিসির বিছানার নীচে গিয়ে লুকিয়েছিল।

বীরাঙ্গনা ভারি খুশি। মনে করিয়ে দিলে ভালুকটার কথা — সে পালাতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল নাবার ঘরের স্নানের জলের টবের মধ্যে।

 

সেই যে মানুষটার ইতিহাস গড়ে উঠেছিল আমার একলার হাতে এখন থেকে পুপেও তাতে যেখানে - সেখানে জোড়া দিতে লাগল। আমি যদি বা বলি, একদিন বেলা তিনটার সময় সে এসেছিল আমার কাছে দাড়ি কামাবার খুর চেয়ে নিতে, আর নিতে খালি বিস্কুটের টিন, পুপে খবর দেয়, সে ওর কাছ থেকে নিয়ে গেছে পশম বোনবার কুরুশ - কাটি।

সব গল্পেরই একটা আরম্ভ আছে, শেষ আছে, কিন্তু ঐ - যে ‘এক যে আছে মানুষ' তার আর শেষ নেই। তার দিদির জ্বর হয়, ডাক্তার ডাকতে যায়। টমি কুকুর আছে, বেড়ালের নখের আঁচড় লেগে তার নাক যায় ছড়ে। পিছন দিক থেকে গোরুর গাড়ির উপর চড়ে বসেছিল, তাই নিয়ে গাড়োয়ানের সঙ্গে হয় বিষম বচসা। উঠোনে কলতলায় পিছলে পড়ে বামুন ঠাক্‌রুনের মাটির ঘড়া দেয় ভেঙে। মোহনবাগানের ফুটবল - ম্যাচ দেখতে গিয়েছিল, পকেট থেকে সাড়ে তিন আনা পয়সা কে নেয় তুলে ; ফির‌্‍তি রাস্তায় ভীমনাগের দোকান থেকে সন্দেশ কেনা বাদ গেল। বন্ধু আছে কিনু চৌধুরী, তার ওখানে গিয়ে কুচো চিংড়ি ভাজা আর আলুর দম ফরমাশ করে। এমনি একটার পর একটা চলছে দিনের পর দিন। এর সঙ্গে পুপে জুড়েছে, কোনোদিন দুপুরবেলায় ওর ঘরে গিয়ে বলেছে মায়ের আলমারি থেকে পাকপ্রণালীর বইখানা খুঁজে বের করতে, বন্ধু সুধাকান্তবাবু শিখতে চায় মোচার ঘণ্ট তৈরি করা। আর - একদিন পুপের সুবাসিত নারিকেল তেল নিয়ে গেল চেয়ে, ভয় হয়েছে মাথায় টাক পড়ে আসছে দেখে। আর - একদিন দিন্‌দার ওখানে গান শুনতে গেল, দিন্‌দা তখন তাকিয়া ঠেসান দিয়ে ঘুমিয়ে।

এই - যে আমাদের এক যে আছে মানুষ, এর একটা নাম নিশ্চয়ই আছে। সে কেবল আমরা দুজনেই জানি, আর - কাউকে বলা বারণ। এইখানটাতেই গল্পের মজা। এক যে ছিল রাজা, তারও নাম নেই ; রাজপুত্র, তারও নাম নেই। আর