রাজর্ষি

বিল্বন ঠাকুর ধ্রুবকে কাছে টানিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার এ সঙ্গী জুটিল কোথা হইতে?”

ধ্রুব খানিকক্ষণ ভাবিয়া কহিল, “আমি টক্‌টক্‌ চ’ব।” টক্‌টক্‌ অর্থে ঘোড়া।

পুরোহিত কহিলেন, “বাহবা, প্রশ্ন ও উত্তরের মধ্যে কী সামঞ্জস্য!”

সহসা মেয়েটির দিকে ধ্রুবের চক্ষু পড়িল, তাহার সম্বন্ধে অতি সংক্ষেপে আপনার মত ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়া কহিল, “ও দুষ্টু, ওকে মা’ব।”

বলিয়া আকাশে আপনার ক্ষুদ্র মুষ্টি নিক্ষেপ করিল!

রাজা গম্ভীরভাবে কহিলেন, “ছি ধ্রুব!”

একটি ফুঁয়ে যেমন প্রদীপ নিবিয়া যায় তেমনি তৎক্ষণাৎ ধ্রুবের মুখ ম্লান হইয়া গেল। প্রথমে সে অশ্রুনিবারণের জন্য দুই মুষ্টি দিয়া দুই চক্ষু রগড়াইতে লাগিল; অবশেষে দেখিতে দেখিতে ক্ষুদ্র স্ফীত হৃদয় আর ধারণ করিতে পারিল না, কাঁদিয়া উঠিল।

বিল্বন ঠাকুর তাহাকে নাড়িয়া-চাড়িয়া, কোলে লইয়া, আকাশে তুলিয়া, ভূমিতে নামাইয়া, অস্থির করিয়া তুলিলেন; উচ্চৈঃস্বরে ও দ্রুত উচ্চারণে বলিলেন, “শোনো শোনো ধ্রুব, শোনো, তোমাকে শ্লোক বলি শোনো–
                               কলহ কটকটাং কাঠ কাঠিন্য কাঠ্যং
                               কটন কিটন কীটং কুট্‌মলং খট্টমট্টং।
অর্থাৎ কি না, যে ছেলে কাঁদে তাকে কলহ কট্‌কটাঙের মধ্যে পুরে খুব করে কাঠ কাঠিন্য কাঠ্যং দিতে হয়, তার পরে এতগুলো কটন কিটন কিটং নিয়ে একেবারে তিন দিন ধরে কুট্‌মলং খট্টমট্টং।”

পুরোহিত ঠাকুর এইরূপ অনর্গল বকিয়া গেলেন। ধ্রুবের ক্রন্দন অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই একেবারে লুপ্ত হইয়া গেল। সে প্রথমে গোলমালে বিব্রত ও অবাক হইয়া বিল্বন ঠাকুরের মুখের দিকে সজল চক্ষু তুলিয়া চাহিয়া রহিল। তার পরে তাঁর হাতমুখ নাড়া দেখিয়া তাহার অত্যন্ত কৌতুক বোধ হইল।

সে ভারি খুশি হইয়া বলিল, “আবার বলো।”

পুরোহিত আবার বকিয়া গেলেন। ধ্রুব অত্যন্ত হাসিতে হাসিতে বলিল, “আবার বলো।”

রাজা ধ্রুবের অশ্রুসিক্ত কপোলে এবং হাসিভরা অধরে বার বার চুম্বন করিলেন। তখন রাজা রাজপুরোহিত ও দুটি ছেলেমেয়ে মিলিয়া খেলা পড়িয়া গেল।

বিল্বন ঠাকুর রাজাকে কহিলেন, “মহারাজ ইহাদের লইয়া বেশ আছেন। দিনরাত প্রখর বুদ্ধিমানদের সঙ্গে থাকিলে বুদ্ধি লোপ পায়। ছুরিতে অবিশ্রাম শান পড়িলে ছুরি ক্রমেই সূক্ষ্ম হইয়া অন্তর্ধান করে। একটা মোটা বাঁট কেবল অবশিষ্ট থাকে।”

রাজা হাসিয়া কহিলেন, “এখনো তবে বোধ করি আমার সূক্ষ্ম বুদ্ধির লক্ষণ প্রকাশ পায় নাই।”

বিল্বন। না। সূক্ষ্ম বুদ্ধির একটা লক্ষণ এই যে, তাহা সহজ জিনিসকে শক্ত করিয়া তুলে। পৃথিবীতে বিস্তর বুদ্ধিমান না থাকিলে পৃথিবীর কাজ অনেকটা সোজা হইত। নানারূপ সুবিধা করিতে গিয়াই নানারূপ অসুবিধা ঘটে। অধিক বুদ্ধি লইয়া মানুষ কী করিবে ভাবিয়া পায় না।

রাজা কহিলেন, “পাঁচটা আঙুলেই বেশ কাজ চলিয়া যায় দুর্ভাগ্যক্রমে সাতটা আঙুল পাইলে ইচ্ছা করিয়া কাজ বাড়াইতে হয়।”

রাজা ধ্রুবকে ডাকিলেন। ধ্রুব তাহার সঙ্গিনীর সহিত পুনরায় শান্তি স্থাপন করিয়া খেলা করিতেছিল। রাজার ডাক শুনিয়া তৎক্ষণাৎ খেলা ছাড়িয়া রাজার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল। রাজা তাহাকে সম্মুখে বসাইয়া কহিলেন, “ধ্রুব সেই নূতন গানটি