রাজর্ষি

বিল্বন আসিয়া কহিলেন, “মহারাজ, এ সময় কি আকাশের দিকে তাকাইয়া ভাবিবার সময়?”

রাজা কহিলেন, “ঠাকুর, এ সকল আমারই পাপের ফল।”

বিল্বন কিঞ্চিৎ বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “মহারাজ, এই-সকল কথা শুনিলে আমার ধৈর্য থাকে না। দুঃখ যে পাপেরই ফল তাহা কে বলিল, পুণ্যের ফলও হইতে পারে। কত ধর্মাত্মা আজীবন দুঃখে কাটাইয়া গিয়াছেন।”

রাজা নিরুত্তর হইয়া রহিলেন।

বিল্বন জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ কী পাপ করিয়াছিলেন যাহার ফলে এই ঘটনা ঘটিল?”

রাজা কহিলেন, “আপন ভাইকে নির্বাসিত করিয়াছিলাম।”

বিল্বন কহিলেন, “আপনি ভাইকে নির্বাসিত করেন নাই। দোষীকে নির্বাসিত করিয়াছেন।”

রাজা কহিলেন, “দোষী হইলেও ভাইকে নির্বাসনের পাপ আছেই। তাহার ফল হইতে নিস্তার পাওয়া যায় না। কৌরবেরা দুরাচার হইলেও পাণ্ডবেরা তাঁহাদিগকে বধ করিয়া প্রসন্নচিত্তে রাজ্যসুখ ভোগ করিতে পারিলেন না। যজ্ঞ করিয়া প্রায়শ্চিত্ত করিলেন। পাণ্ডবেরা কৌরবদের নিকট হইতে রাজ্য লইলেন, কৌরবেরা মরিয়া গিয়া পাণ্ডবদের রাজ্য হরণ করিলেন। আমি নক্ষত্রকে নির্বাসিত করিয়াছি, নক্ষত্র আমাকে নির্বাসিত করিতে আসিতেছে।”

বিল্বন কহিলেন, “পাণ্ডবেরা পাপের শাস্তি দিবার জন্য কৌরবদের সহিত যুদ্ধ করেন নাই, তাঁহারা রাজ্যলাভের জন্য করিয়াছিলেন। কিন্তু মহারাজ পাপের শাস্তি দিয়া নিজের সুখদুঃখ উপেক্ষা করিয়া ধর্ম পালন করিয়াছিলেন। ইহাতে আমি তো পাপ কিছুই দেখিতেছি না। তবে প্রায়শ্চিত্তের বিধি দিতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই। আমি ব্রাহ্মণ উপস্থিত আছি, আমাকে সন্তুষ্ট করিলেই প্রায়শ্চিত্ত হইবে।”

রাজা ঈষৎ হাসিয়া চুপ করিয়া রহিলেন।

বিল্বন কহিলেন, “সে যাহাই হউক, এখন যুদ্ধের আয়োজন করুন। আর বিলম্ব করিবেন না।”

রাজা কহিলেন, “আমি যুদ্ধ করিব না।”

বিল্বন কহিলেন, “সে হইতেই পারে না। আপনি বসিয়া বসিয়া ভাবুন। আমি ততক্ষণ সৈন্যসংগ্রহের চেষ্টা করিগে। সকলেই এখন জুমে গিয়াছে, যথেষ্ট সৈন্য পাওয়া কঠিন।”

বলিয়া আর কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া বিল্বন চলিয়া গেলেন।

ধ্রুবের সহসা কী মনে হইল; সে রাজার কাছে আসিয়া রাজার মুখের দিকে তাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কাকা কোথায়?”

নক্ষত্ররায়কে ধ্রুব কাকা বলিত।

রাজা কহিলেন “কাকা আসিতেছেন ধ্রুব।”

তাঁহার চোখের পাতা ঈষৎ আর্দ্র হইয়া গেল।