রাজর্ষি
সুদূর পশ্চিমে সন্ধ্যারাগরক্ত শ্যামল বনভূমির দিকে অনিমেষ নেত্রে চাহিয়া রহিলেন। চারি দিকে নিস্তব্ধ সন্ধ্যা অতলস্পর্শ শব্দহীন শান্ত সমুদ্রের মতো জাগিয়া রহিল। ক্রমে তাঁহার চক্ষে জল দেখা দিল, দ্রুতবেগে অশ্রু পড়িতে লাগিল। সহসা লজ্জায় ও অনুতাপে নক্ষত্ররায় দুই হাতে মুখ প্রচ্ছন্ন করিয়া ধরিলেন।

কাঁদিয়া বলিলেন, “আমি এ রাজ্য চাই না। দাদা, আমার সমস্ত অপরাধ মার্জনা করিয়া আমাকে তোমার পদতলে স্থান দাও, আমাকে তোমার কাছে রাখিয়া দাও, আমাকে দূরে তাড়াইয়া দিয়ো না।”

বিল্বন একটি কথাও বলিলেন না– আর্দ্র হৃদয়ে চুপ করিয়া বসিয়া দেখিতে লাগিলেন। অবশেষে নক্ষত্ররায় যখন প্রশান্ত হইলেন, তখন বিল্বন কহিলেন, “যুবরাজ, আপনার পথ চাহিয়া গোবিন্দমাণিক্য বসিয়া আছেন আর বিলম্ব করিবেন না।”

নক্ষত্ররায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমাকে কি তিনি মাপ করিবেন?”

বিল্বন কহিলেন, “তিনি যুবরাজের প্রতি কিছুমাত্র রাগ করেন নাই। অধিক রাত্রি হইলে পথে কষ্ট হইবে। শীঘ্র একটি অশ্ব লউন। পর্বতের নীচে মহারাজের লোক অপেক্ষা করিয়া আছে।”

নক্ষত্ররায় কহিলেন, “আমি গোপনে পলায়ন করি, সৈন্যদের কিছু জানাইয়া কাজ নাই। আর তিলমাত্র বিলম্ব করিয়া কাজ নাই, যত শীঘ্র এখান হইতে বাহির হইয়া পড়া যায় ততই ভালো।”

বিল্বন কহিলেন, “ঠিক কথা।”

তিনমুড়া পাহাড়ে সন্ন্যাসীর সহিত শিবলিঙ্গের পূজা করিতে যাইতেছেন বলিয়া নক্ষত্ররায় বিল্বনের সহিত অশ্বারোহণে যাত্রা করিলেন। অনুচরগণ সঙ্গে যাইতে চাহিল, তাহাদিগকে নিরস্ত করিলেন।

সবে বাহির হইয়াছেন মাত্র, এমন সময়ে অশ্বের ক্ষুরধ্বনি ও সৈন্যদের কোলাহল শুনিতে পাইলেন। নক্ষত্ররায় নিতান্ত সংকুচিত হইয়া গেলেন। দেখিতে দেখিতে রঘুপতি সৈন্য লইয়া ফিরিয়া আসিলেন। আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “মহারাজ, কোথায় যাইতেছেন?”

নক্ষত্ররায় কিছুই উত্তর দিতে পারিলেন না। নক্ষত্ররায়কে নিরুত্তর দেখিয়া বিল্বন কহিলেন, “মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইতেছেন।”

রঘুপতি বিল্বনের আপাদমস্তক একবার নিরীক্ষণ করিলেন, একবার ভ্রূ কুঞ্চিত করিলেন, তার পরে আত্মসম্বরণ করিয়া কহিলেন, “আজ এমন অসময়ে আমরা আমাদের মহারাজকে বিদায় দিতে পারি না। ব্যস্ত হইবার তো কোনো কারণ নাই। কাল প্রাতঃকালে যাত্রা করিলেই তো হইবে। কী বলেন মহারাজ?”

নক্ষত্ররায় মৃদুস্বরে কহিলেন, “কাল সকালেই যাইব, আজ রাত হইয়া গেছে।”

বিল্বন নিরাশ হইয়া সে রাত্রি শিবিরেই যাপন করিলেন। পরদিন প্রভাতে নক্ষত্ররায়ের নিকট যাইতে চেষ্টা করিলেন, সৈন্যেরা বাধা দিল। দেখিলেন চতুর্দিকে পাহারা, কোনো দিকে ছিদ্র নাই। অবশেষে রঘুপতির নিকট গিয়া কহিলেন, “যাত্রার সময় হইয়াছে, যুবরাজকে সংবাদ দিন।”

রঘুপতি কহিলেন, “মহারাজ যাইবেন না স্থির করিয়াছেন।”

বিল্বন কহিলেন, “আমি একবার তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে ইচ্ছা করি।”

রঘুপতি। সাক্ষাৎ হইবে না তিনি বলিয়া দিয়াছেন।

বিল্বন কহিলেন, “মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের পত্রের উত্তর চাই।”

রঘুপতি। পত্রের উত্তর ইতিপূর্বে আর-একবার দেওয়া হইয়াছে।

বিল্বন। আমি তাঁহার নিজমুখে উত্তর শুনিতে চাই।

রঘুপতি। তাহার কোনো উপায় নাই।