ললাটের লিখন
বাঙালি পাঠকের বিগলিত হৃদয় শুধু কেবল ছাপানো বইয়ের পাতাকেই বাষ্পাকৃত করেছে, তা নয়, সিনেমা থিয়েটারেও তার আর্দ্রতা প্রতি সন্ধ্যায় ব্যাপ্ত হয়ে থাকে। এই সাধারণ বাঙালি পাঠক ও দর্শকের অশিক্ষিত রুচির প্রতি যে পৃথ্বীশ অপরিসীম অবজ্ঞা অনুভব করে সেই মানুষেরই 'পরে ভাগ্যের এই বিচার।

একটা রূঢ় কথা ওর মুখ দিয়ে বেরচ্ছিল, এমন সময় [বাঁশরি ] অলক্ষ্য পথ দিয়ে ওদের পিছনে এসে দাঁড়ালে। ওকে দেখেই সোমশংকর চমকে দাঁড়িয়ে উঠল, লাল হয়ে উঠল তার মুখ। বাঁশরি বললে, “ শংকর, আজ আমার এখানে নেমন্তন্ন ছিল না। ধরে নিচ্ছি সেটা আমার গ্রহের ভুল নয়, গৃহকর্তাদেরই ভুল, সংশোধন করবার জন্যে এলুম। সুষমার সঙ্গে আজ তোমার এনগেজমেন্টের দিন, অথচ এ সভায় আমি নেই এ কখনো হতেই পারে না। খুশি হও-নি অনাহূত এসেছি বলে। ”

“ খুব খুশি হয়েছি সে কি বলতে হবে। ”

“ সে কথাটা ভালো ক'রে বলবার জন্যে চলো ওই ফোয়ারার ধারে ময়ূরের ঘরের কাছে। পৃথ্বীশবাবু নিশ্চয়ই প্লটের জন্য একমনে ছিপ ফেলে বসে আছেন, ওঁর ওই অবকাশটা নষ্ট করলে বঙ্গসাহিত্যের ক্ষতি হবে। দেখছ-না সর্বসাধারণ থেকে অসীম দূরে এক কোণে আছেন বসে। ”

সোমশংকরের হাতে হাত ঝুলিয়ে বাঁশরি চলে গেল ময়ূরের ঘরের দিকে। পুকুরের মাঝখানে ফোয়ারা। ঘাটের পাশে চাঁপা গাছ। গাছের তলায় ঘাসের উপর বসল দুজনে। সোমশংকর সংকোচ বোধ করলে, সবাই তাদের দূর থেকে দেখছে। কিন্তু বাঁশরির ইঙ্গিত অবহেলা করবার শক্তি নেই তার রক্তে। পুলক লাগল ওর দেহে। বাঁশরি বললে, “ সময় বেশি নেই, কাজের কথাটা এখনি সেরে ছুটি দেব। তোমার নতুন এনগেজমেন্টের রাস্তায় পুরোনো জঞ্জাল জমেছে, সেগুলো সাফ করে ফেললে পথটা পরিষ্কার হবে। এই নাও। ”

এই বলে একটা পান্নার কন্ঠী, হীরের ব্রেসলেট, একটা মুক্তো বসানো বড়ো গোল ব্রোচ ফুলকাটা রেশমের থলি থেকে বের করে সোমশংকরকে দেখিয়ে আবার থলিতে ভ'রে তার কোলের উপর ফেলে দিলে। থলিটা বাঁশরির নিজের হাতের কাজ করা। সোমশংকর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, “ বাঁশি, জানো আমার মুখে কথা জোগায় না। যতটুকু বলতে পারলেম না তার সব মানে নিজে বুঝে নিয়ো। ” বাঁশরি দাঁড়িয়ে উঠল। বললে, “ সব কথাই আমার জানা, মানে আমি বুঝি। এখন যাও, তোমাদের সময় হল। ”

“ যেয়ো না বাঁশি, ভুল বুঝো না আমাকে। আমার শেষ কথাটা শুনে যাও। আমি জঙ্গলের মানুষ শহরে এসে কলেজে পড়া আরম্ভের মুখে প্রথম তোমার সঙ্গে দেখা। সে দৈবের খেলা। তুমিই আমাকে মানুষ করে দিয়েছিলে। তার দাম কিছুতে শোধ হবে না। তুচ্ছ এই গয়নাগুলো। ”

“ আমার শেষ কথাটা শোনো শংকর। আমার তখন প্রথম বয়েস, তুমি এসে পড়লে সেই নতুন-জাগা অরুণ রঙের মধ্যে, ডাক দিয়ে বাইরে আনলে যাকে তাকে নাও বা না নাও, নিজে তো তাকে পেলুম। আত্মপরিচয় ঘটল, বাস। দুই পক্ষের হয়ে গেল শোধবোধ। এখন দুইজনে অঋণী হয়ে আপন-আপন পথে চললুম, আর কী চাই। ” সোমশংকর থলিটা পকেটের মধ্যে পুরে গয়নাগুলো ফেলে দিলে পুকুরে। বাঁশরি দ্রুতপদে চলে গেল যেখানে বসে আছে পৃথ্বীশ। সকলেরই লক্ষ্যগোচর ভাবে বসল তার পাশে। প্রশ্রয় পেয়ে পৃথ্বীশ একটু ঝগড়ার সুরে বললে, “ এত দেরি করে এলে যে। ”

“ প্রমাণ করবার জন্যে যে বাঘ-ভাল্লুকের মধ্যে আসো নি। সবাই বলে উপন্যাসের নতুন পথ খুলেছ নিজের জোরে, আর এখানকার এই পুতুল নাচের মেলায় পথটা বের করতে ওফিস্যাল গাইড চাই, লোকে যে হাসবে। ”

“ পথ না পাই তো অন্তর গাইডকে তো পাওয়া গেল। ” এই বলে একটু ভাবের ঝোঁক দিয়ে ওর দিকে তাকালে। এই