শেষের রাত্রি

“দেখো বউ, অনেক সয়েছি— কিন্তু এই নিয়ে যদি তুমি যতীনের কাছে যাও, কিছুতেই সইব না। তোমার বাবা তোমাকে ভালো রকমই চেনেন, তাঁকে ভোলাতে পারবে না।”

এই বলিয়া মাসি চলিয়া আসিলেন। মণি খানিকক্ষণের জন্য রাগ করিয়া বিছানায় উপর পড়িয়া রহিল।

পাশের বাড়ি হইতে সই আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এ কি সই, গোসা কেন।”

“ দেখো দেখি ভাই, আমার একমাত্র বোনের অন্নপ্রাশন— এরা আমাকে যেতে দিতে চায় না।”

“ওমা, সে কী কথা, যাবে কোথায়। স্বামী যে রোগে শুষছে।”

“আমি তো কিছুই করি নে, করিতে পারিও নে ; বাড়িতে সবাই চুপচাপ,আমার প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। এমন ক’রে আমি থাকিতে পারি নে, তা বলছি! ”

“তুমি ধন্যি মেয়েমানুষ যা হোক।”

“তা আমি, ভাই, তোমাদের মতো লোক দেখানে ভান করতে পারি নে। পাছে কেউ কিছু মনে করে বলে মুখ গুঁজড়ে ঘরের কোণে পড়ে থাকা আমার কর্ম নয়।”

“তা, কী করবে শুনি।”

“আমি যাবই, আমাকে কেউ ধরে রাখতে পারবে না।”

“ইস্‌, তেজ দেখে আর বাঁচি নে। চললুম, আমার কাজ আছে।”

বাপের বাড়ি যাইবার প্রসঙ্গে মণি কাঁদিয়াছে— এই খবরে যতীন বিচলিত হইয়া বালিশটাকে পিঠের কাছে টানিয়া তুলিল এবং একটু উঠিয়া হেলান দিয়া বসিল। বলিল, “মাসি, এই জানালাটা আর-একটু খুলে দাও,আর এই আলোটা এ ঘরে দরকার নেই।”

জানালা খুলিতেই স্তব্ধ রাত্রি অনন্ত তীর্থপথের পথিকের মতো রোগীর দরজার কাছে চুপ করিয়া দাঁড়াইল। কত যুগের কত মৃত্যুকালের সাক্ষী ঐ তারাগুলি যতীনের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল।

যতীন এই বৃহৎ অন্ধকারের পটের উপর তাহার মণির মুখখানি দেখিতে পাইল। সেই মুখের ডাগর দুটি চক্ষু মোটা মোটা জলের ফোঁটার ভরা— সে জল যেন আর শেষ হইল না, চিরকালের জন্য ভরিয়া রহিল।

অনেকক্ষণ সে চুপ করিয়া আছে দেখিয়া মাসি নিশ্চিত হইলেন। ভাবিলেন, যতীনের ঘুম আসিয়াছে।

এমন সময় হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল, “মাসি,তোমরা কিন্তু বারবার মনে করে এসেছ,মণির মন চঞ্চল,আমাদের ঘরে ওর মন বসে নি। কিন্তু দেখো—”

“না,বাবা,ভুল বুঝেছিলুম– সময় হলেই মানুষকে চেনা যায়! ”

“মাসি! ”

“যতীন, ঘুমোও, বাবা।”

“আমাকে একটু ভাবতে দাও, একটু কথা কইতে দাও! বিরক্ত হোয়ো না মাসি।”

“আচ্ছা, বলো,বাবা।”

“আমি বলছিলুম, মানুষের নিজের মন নিজে বুঝতে কত সময় লাগে ! একদিন যখন মনে করতুম, আমরা কেউ মণির মন