একটা আষাঢ়ে গল্প

 

সেই পরপারে, সেই বিদেশে, এক দুয়ারানীর ছেলে এক রাজপুত্র বাস করে। সে তাহার নির্বাসিত মাতার সহিত সমুদ্রতীরে আপনমনে বাল্যকাল যাপন করিতে থাকে।

সে একা বসিয়া বসিয়া মনে মনে এক অত্যন্ত বৃহৎ অভিলাষের জাল বুনিতেছে। সেই জাল দিগ্‌দিগন্তরে নিক্ষেপ করিয়া কল্পনায় বিশ্বজগতের নব নব রহস্যরাশি সংগ্রহ করিয়া আপনার দ্বারের কাছে টানিয়া তুলিতেছে। তাহার অশান্ত চিত্ত সমুদ্রের তীরে আকাশের সীমায় ঐ দিগন্তরোধী নীল গিরিমালার পরপারে সর্বদা সঞ্চরণ করিয়া ফিরিতেছে — খুঁজিতে চায় কোথায় পক্ষীরাজ ঘোড়া, সাপের মাথায় মানিক, পারিজাত পুষ্প, সোনার কাঠি, রুপার কাঠি পাওয়া যায়, কোথায় সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে দুর্গম দৈত্যভবনে স্বপ্নসম্ভবা অলোকসুন্দরী রাজকুমারী ঘুমাইয়া রহিয়াছেন।

রাজপুত্র পাঠশালে পড়িতে যায়, সেখানে পাঠান্তে সদাগরের পুত্রের কাছে দেশ-বিদেশের কথা এবং কোটালের পুত্রের কাছে তাল-বেতালের কাহিনী শোনে।

ঝুপ্‌ ঝুপ্‌ করিয়া বৃষ্টি পড়ে, মেঘে অন্ধকার হইয়া থাকে — গৃহদ্বারে মায়ের কাছে বসিয়া সমুদ্রের দিকে চাহিয়া রাজপুত্র বলে, মা, একটা খুব দূর দেশের গল্প বলো। মা অনেক ক্ষণ ধরিয়া তাঁহার বাল্যশ্রুত এক অপূর্ব দেশের অপূর্ব গল্প বলিতেন- বৃষ্টির ঝর্‌ঝর্‌ শব্দের মধ্যে সেই গল্প শুনিয়া রাজপুত্রের হৃদয় উদাস হইয়া যাইত।

একদিন সদাগরের পুত্র আসিয়া রাজপুত্রকে কহিল, সাঙাত, পড়াশুনা তো সাঙ্গ করিয়াছি, এখন একবার দেশভ্রমণে বাহির হইব, তাই বিদায় লইতে আসিলাম। ”

রাজার পুত্র কহিল, “ আমিও তোমার সঙ্গে যাইব। ”

কোটালের পুত্র কহিল, “ আমাকে কি একা ফেলিয়া যাইবে। আমিও তোমাদের সঙ্গী। ”

রাজপুত্র দুঃখিনী মাকে গিয়া বলিল, “ মা, আমি ভ্রমণে বাহির হইতেছি — এবার তোমার দুঃখমোচনের উপায় করিয়া আসিব। ”

তিন বন্ধুতে বাহির হইয়া পড়িল।


 

সমুদ্রে সদাগরের দ্বাদশতরী প্রস্তুত ছিল- তিন বন্ধু চড়িয়া বসিল। দক্ষিণের বাতাসে পাল ভরিয়া উঠিল, নৌকাগুলা রাজপুত্রের হৃদয়বাসনার মতো ছুটিয়া চলিল।

শঙ্খদ্বীপে গিয়া একনৌকা শঙ্খ, চন্দনদ্বীপে গিয়া এক-নৌকা চন্দন, প্রবালদ্বীপে গিয়া এক-নৌকা প্রবাল বোঝাই হইল।

তাহার পর আর চারি বৎসরে গজদন্ত মৃগনাভি লবঙ্গ জায়ফলে যখন আর-চারিটি নৌকা পূর্ণ হইল তখন সহসা একটা বিপর্যয় ঝড় আসিল।

সব-কটা নৌকা ডুবিল, কেবল একটি নৌকা তিন বন্ধুকে একটা দ্বীপে আছাড়িয়া ফেলিয়া খান্‌ খান্‌ হইয়া গেল।