চোখের বালি

আশাকে বলিত, “বোঠান, গিলিয়া খাইলে হজম হয় না, চিবাইয়া খাইতে হয়। এখন সমস্ত অন্ন এক গ্রাসে গিলিতেছ, ইহার পরে হজমি গুলি খুঁজিয়া পাইবে না।”

মহেন্দ্র বলিত, “চুনি, ও কথা শুনিয়ো না– বিহারী আমাদের সুখে হিংসা করিতেছে।”

বিহারী বলিত, “সুখ যখন তোমার হাতেই আছে, তখন এমন করিয়া ভোগ করো যাহাতে পরের হিংসা না হয়।”

মহেন্দ্র উত্তর করিত, “পরের হিংসা পাইতে যে সুখ আছে। চুনি, আর-একটু হইলেই আমি গর্দভের মতো তোমাকে বিহারীর হাতে সমর্পণ করিতেছিলাম।”

বিহারী রক্তবর্ণ হইয়া বলিয়া উঠিত, “চুপ!”

এই-সকল ব্যাপারে আশা মনে মনে বিহারীর উপরে ভারি বিরক্ত হইত। এক সময়ে তাহার সহিত বিহারীর বিবাহ-প্রস্তাব হইয়াছিল বলিয়াই বিহারীর প্রতি তাহার একপ্রকার বিমুখ ভাব ছিল, বিহারী তাহা বুঝিত এবং মহেন্দ্র তাহা লইয়া আমোদ করিত।

রাজলক্ষ্মী বিহারীকে ডাকিয়া দুঃখ করিতেন। বিহারী কহিত, “মা, পোকা যখন গুটি বাঁধে তখন তত বেশি ভয় নয়, কিন্তু যখন কাটিয়া উড়িয়া যায় তখন ফেরানো শক্ত। কে মনে করিয়াছিল, ও তোমার বন্ধন এমন করিয়া কাটিবে।”

মহেন্দ্রের ফেল-করা সংবাদে রাজলক্ষ্মী গ্রীষ্মকালের আকস্মিক অগ্নিকাণ্ডের মতো দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিলেন, কিন্তু তাহার গর্জন এবং দাহনটা সম্পূর্ণ ভোগ করিলেন অন্নপূর্ণা। তাঁহার আহারনিদ্রা দূর হইল।

একদিন নববর্ষার বর্ষণমুখরিত মেঘাচ্ছন্ন সায়াহ্নে গায়ে একখানি সুবাসিত ফুরফুরে চাদর এবং গলায় একগাছি জুঁইফুলের গোড়ে মালা পরিয়া মহেন্দ্র আনন্দমনে শয়নগৃহে প্রবেশ করিল। হঠাৎ আশাকে বিস্ময়ে চকিত করিবে বলিয়া জুতার শব্দ করিল না। ঘরে উঁকি দিয়া দেখিল, পুব দিকের খোলা জানালা দিয়া প্রবল বাতাস বৃষ্টির ছাট লইয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিতেছে, বাতাসে দীপ নিবিয়া গেছে এবং আশা নীচের বিছানার উপরে পড়িয়া অব্যক্তকণ্ঠে কাঁদিতেছে।

মহেন্দ্র দ্রুতপদে কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কী হইয়াছে।”

বালিকা দ্বিগুণ আবেগে কাঁদিয়া উঠিল। অনেকক্ষণ পরে মহেন্দ্র ক্রমশ উত্তর পাইল যে, মাসিমা আর সহ্য করিতে না পারিয়া তাঁহার পিসতুত ভাইয়ের বাসায় চলিয়া গেছেন।

মহেন্দ্র রাগিয়া মনে করিল, ‘গেলেন যদি, এমন বাদলার সন্ধ্যাটা মাটি করিয়া গেলেন!’

শেষকালে সমস্ত রাগ মাতার উপরে পড়িল। তিনিই তো সকল অশান্তির মূল।

মহেন্দ্র কহিল, “কাকী যেখানে গেছেন, আমরাও সেইখানে যাইব, দেখি, মা কাহাকে লইয়া ঝগড়া করেন।”

বলিয়া অনাবশ্যক শোরগোল করিয়া জিনিসপত্র বাঁধাবাঁধি মুটে-ডাকাডাকি শুরু করিয়া দিল।

রাজলক্ষ্মী সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিলেন। ধীরে ধীরে মহেন্দ্রের কাছে আসিয়া শান্তস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় যাইতেছিস।”

মহেন্দ্র প্রথমে কোনো উত্তর করিল না। দুই-তিন বার প্রশ্নের পর উত্তর করিল, “কাকীর কাছে যাইব।”

রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তোদের কোথাও যাইতে হইবে না, আমিই তোর কাকীকে আনিয়া দিতেছি।”

বলিয়া তৎক্ষণাৎ পালকি চড়িয়া অন্নপূর্ণার বাসায় গেলেন। গলায় কাপড় দিয়া জোড়হাত করিয়া কহিলেন, “প্রসন্ন হও মেজোবউ, মাপ করো।”

অন্নপূর্ণা শশব্যস্ত হইয়া রাজলক্ষ্মীর পায়ের ধুলা লইয়া কাতরস্বরে কহিলেন, “দিদি, কেন আমাকে অপরাধী করিতেছ।