চোখের বালি
এই সুসজ্জিত শয়নঘরের দিকে চায়, আর সে কথা কিছুতেই ভুলিতে পারে না। এ ঘরে আজ সে অতিথিমাত্র– আজ স্থান পাইয়াছে, কাল আবার উঠিয়া যাইতে হইবে।

অপরাহ্নে বিনোদিনী নিজে উদ্‌‍যোগী হইয়া অপরূপ নৈপুণ্যের সহিত আশার চুল বাঁধিয়া সাজাইয়া তাহাকে স্বামিসম্মিলনে পাঠাইয়া দিত। তাহার কল্পনা যেন অবগুণ্ঠিতা হইয়া এই সজ্জিতা বধূর পশ্চাৎ পশ্চাৎ মুগ্ধ যুবকের অভিসারে জনহীন কক্ষে গমন করিত। আবার এক-এক দিন কিছুতেই আশাকে ছাড়িয়া দিত না। বলিত, “আঃ, আর-একটু বসোই-না। তোমার স্বামী তো পালাইতেছেন না। তিনি তো বনের মায়ামৃগ নন, তিনি অঞ্চলের পোষা হরিণ।” এই বলিয়া নানা ছলে ধরিয়া রাখিয়া দেরি করাইবার চেষ্টা করিত।

মহেন্দ্র অত্যন্ত রাগ করিয়া বলিত, “তোমার সখী যে নড়িবার নাম করেন না– তিনি বাড়ি ফিরিবেন কবে।”

আশা ব্যগ্র হইয়া বলিত, “না, তুমি আমার চোখের বালির উপর রাগ করিয়ো না। তুমি জান না, সে তোমার কথা শুনিতে কত ভালোবাসে– কত যত্ন করিয়া সাজাইয়া আমাকে তোমার কাছে পাঠাইয়া দেয়।”

রাজলক্ষ্মী আশাকে কাজ করিতে দিতেন না। বিনোদিনী বধূর পক্ষ লইয়া তাহাকে কাজে প্রবৃত্ত করাইল। প্রায় সমস্ত দিনই বিনোদিনীর কাজে আলস্য নাই, সেইসঙ্গে আশাকেও সে আর ছুটি দিতে চায় না। বিনোদিনী পরে-পরে এমনি কাজের শৃঙ্খল বানাইতেছিল যে, তাহার মধ্যে ফাঁক পাওয়া আশার পক্ষে ভারি কঠিন হইয়া উঠিল। আশার স্বামী ছাদের উপরকার শূন্য ঘরের কোণে বসিয়া আক্রোশে ছটফট করিতেছে, ইহা কল্পনা করিয়া বিনোদিনী মনে মনে তীব্র কঠিন হাসি হাসিত। আশা উদ্‌বিগ্ন হইয়া বলিত, “এবার যাই ভাই চোখের বালি, তিনি আবার রাগ করিবেন।”

বিনোদিনী তাড়াতাড়ি বলিত, “রোসো, এইটুকু শেষ করিয়া যাও। আর বেশি দেরি হইবে না।”

খানিক বাদে আশা আবার ছটফট করিয়া বলিয়া উঠিত, “না ভাই, এবার তিনি সত্যসত্যই রাগ করিবেন-আমাকে ছাড়ো, আমি যাই।”

বিনোদিনী বলিত, “আহা, একটু রাগ করিলই বা। সোহাগের সঙ্গে রাগ না মিশিলে ভালোবাসার স্বাদ থাকে না– তরকারিতে লঙ্কামরিচের মতো।”

কিন্তু লঙ্কামরিচের স্বাদটা যে কী, তাহা বিনোদিনীই বুঝিতেছিল– কেবল সঙ্গে তাহার তরকারি ছিল না। তাহার শিরায় শিরায় যেন আগুন ধরিয়া গেল। সে যে দিকে চায়, তাহার চোখে যেন স্ফুলিঙ্গবর্ষণ হইতে থাকে। ‘এমন সুখের ঘরকন্না– এমন সোহাগের স্বামী। এ ঘরকে যে আমি রাজার রাজত্ব, এ স্বামীকে যে আমি পায়ের দাস করিয়া রাখিতে পারিতাম। তখন কি এ ঘরের এই দশা, এ মানুষের এই ছিরি থাকিত। আমার জায়গায় কিনা এই কচি খুকি, এই খেলার পুতুল!’ (আশার গলা জড়াইয়া) “ভাই চোখের বালি, বলো-না ভাই, কাল তোমাদের কী কথা হইল ভাই। আমি তোমাকে যাহা শিখাইয়া দিয়াছিলাম তাহা বলিয়াছিলে? তোমাদের ভালোবাসার কথা শুনিলে আমার ক্ষুধাতৃষ্ণা থাকে না ভাই।”