মুক্তির উপায়

বহুকাল তাহার আর সাক্ষাৎ নাই। কখনো কখনো শুনা যায়, এক বিবাহে কিরূপ সুখ তাহাই পরীক্ষা করিবার জন্য সে কাশীতে গিয়া গোপনে আর-একটি বিবাহ করিয়াছে; শুনা যায়, হতভাগ্য কথঞ্চিৎ শান্তি লাভ করিয়াছে। কেবল দেশের কাছাকাছি আসিবার জন্য মাঝে মাঝে তাহার মন উতলা হয়, ধরা পড়িবার ভয়ে আসিতে পারে না।

কিছুদিন ঘুরিতে ঘুরিতে উদাসীন ফকিরচাঁদ নবগ্রামে আসিয়া উপস্থিত। পথপার্শ্ববর্তী এক বটবৃক্ষ-তলে বসিয়া নিশ্বাস ছাড়িয়া বলিল, “আহা, বৈরাগ্যমেবাভয়ং। দারাপুত্র ধনজন কেউ কারো নয়। কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ।” বলিয়া এক গান জুড়িয়া দিল—

                    “শোন্‌ রে শোন, অবোধ মন,

            শোন্‌ সাধুর উক্তি- কিসে মুক্তি

                    সেই সুযুক্তি কর্‌ গ্রহণ।

            ভবের শুক্তি ভেঙে মুক্তি-মুক্তা কর্‌ অন্বেষণ।

                    ওরে   ও ভোলা মন, ভোলা মন রে”।

সহসা গান বন্ধ হইয়া গেল। “ও কে ও। বাবা দেখছি! সন্ধান পেয়েছেন বুঝি! তবে তো সর্বনাশ। আবার তো সংসারের অন্ধকূপে টেনে নিয়ে যাবেন। পালাতে হল।”


ফকির তাড়াতাড়ি নিকটবর্তী এক গৃহে প্রবেশ করিল। বৃদ্ধ গৃহস্বামী চুপচাপ বসিয়া তামাক টানিতেছিল। ফকিরকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কে হে তুমি।”

ফকির। বাবা, আমি সন্ন্যাসী।

বৃদ্ধ। সন্ন্যাসী! দেখি দেখি বাবা, আলোতে এসো দেখি।

এই বলিয়া আলোতে টানিয়া লইয়া ফকিরের মুখের ’পরে ঝুঁকিয়া বুড়ামানুষ বহু কষ্টে যেমন করিয়া পুঁথি পড়ে তেমনি করিয়া ফকিরের মুখ নিরীক্ষণ করিয়া বিড় বিড় করিয়া বকিতে লাগিল—

“এই তো আমার সেই মাখনলাল দেখছি। সেই নাক, সেই চোখ, কেবল কপালটা বদলেছে, আর সেই চাঁদমুখ গোঁফে দাড়িতে একেবারে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।”

বলিয়া বৃদ্ধ সস্নেহে ফকিরের শ্মশ্রুল মুখে দুই-একবার হাত বুলাইয়া লইল এবং প্রকাশ্যে কহিল, “বাবা মাখন।”

বলা বাহুল্য বৃদ্ধের নাম ষষ্ঠীচরণ।

ফকির। (সবিস্ময়ে) মাখন! আমার নাম তো মাখন নয়। পূর্বে আমার নাম যাই থাক্‌, এখন আমার নাম চিদানন্দস্বামী। ইচ্ছা হয় তো পরমানন্দও বলতে পারো।

ষষ্ঠী। বাবা, তা এখন আপনাকে চিঁড়েই বল্‌ আর পরমান্নই বল্‌, তুই যে আমার মাখন, বাবা, সে তো আমি ভুলতে পারব না।