গোরা

সাধনাশ্রমের দ্বার বদ্ধ। দুই-এক বার ধাক্কা দিল, খুলিল না— কেহ সাড়াও দিল না। ভিতর হইতে ধূপধুনার গন্ধ আসিতেছে। কৃষ্ণদয়াল আজ সন্ন্যাসীকে লইয়া অত্যন্ত গূঢ় এবং অত্যন্ত দুরূহ একটি যোগের প্রণালী সমস্ত দ্বার রুদ্ধ করিয়া অভ্যাস করিতেছেন— আজ সমস্ত রাত্রি সে দিকে কাহারও প্রবেশ করিবার অধিকার নাই।

৭৪

গোরা কহিল—‘না। প্রায়শ্চিত্ত কাল না। আজই আমার প্রায়শ্চিত্ত আরম্ভ হয়েছে। কালকের চেয়ে ঢের বড়ো আগুন আজ জ্বলেছে। আমার নবজীবনের আরম্ভে খুব একটা বড়ো আহুতি আমাকে দিতে হবে বলেই বিধাতা আমার মনে এতবড়ো একটা প্রবল বাসনাকে জাগিয়ে তুলেছেন। নইলে এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটল কেন? আমি ছিলুম কোন্‌ ক্ষেত্রে! এদের সঙ্গে আমার মেলবার কোনো লৌকিক সম্ভাবনা ছিল না। আর এমন বিরুদ্ধভাবের মিলনও পৃথিবীতে সচরাচর ঘটে না। আবার সেই মিলনে আমার মতো উদাসীন লোকের চিত্তেও যে এতবড়ো দুর্জয় একটা বাসনা জাগতে পারে সে কথা কেউ কল্পনাও করতে পারত না। ঠিক আজই আমার এই বাসনার প্রয়োজন ছিল। আজ পর্যন্ত আমি দেশকে যা দিয়ে এসেছি তা অতি সহজেই দিয়েছি, এমন দান কিছু করতে হয় নি যাতে আমাকে কষ্টবোধ করতে হয়েছে। আমি ভেবেই পেতুম না, লোকে দেশের জন্যে কোনো জিনিস ত্যাগ করতে কিছুমাত্র কৃপণতা বোধ করে কেন। কিন্তু বড়ো যজ্ঞ এমন সহজ দান চায় না। দুঃখই চাই। নাড়ী ছেদন করে তবে আমার নবজীবন জন্মগ্রহণ করবে। কাল প্রাতে জনসমাজের কাছে আমার লৌকিক প্রায়শ্চিত্ত হবে। ঠিক তার পূর্বরাত্রেই আমার জীবনবিধাতা এসে আমার দ্বারে আঘাত করেছেন। অন্তরের মধ্যে আমার অন্তরতম প্রায়শ্চিত্ত না হলে কাল আমি শুদ্ধি গ্রহণ করব কেমন করে! যে দান আমার পক্ষে সকলের চেয়ে কঠিন দান সেই দান আমার দেবতাকে আজ সম্পূর্ণ উৎসর্গ করে দিয়ে তবেই আমি সম্পূর্ণ পবিত্ররূপে নিঃস্ব হতে পারব— তবেই আমি ব্রাহ্মণ হব।’

গোরা হরিমোহিনীর সম্মুখে আসিতেই তিনি বলিয়া উঠিলেন, “বাবা, একবার তুমি আমার সঙ্গে চলো। তুমি গেলে, তুমি মুখের একটি কথা বললেই সব হয়ে যাবে।”

গোরা কহিল, “আমি কেন যাব! তাঁর সঙ্গে আমার কী যোগ! কিছুই না।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “সে যে তোমাকে দেবতার মতো ভক্তি করে— তোমাকে গুরু বলে মানে।”

গোরার হৃৎপিণ্ডের এক দিক হইতে আর-এক দিকে বিদ্যুৎতপ্ত বজ্রসূচী বিঁধিয়া গেল। গোরা কহিল, “আমার যাবার প্রয়োজন দেখি নে। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হবার আর-কোনো সম্ভাবনা নেই।”

হরিমোহিনী খুশি হইয়া কহিলেন, “সে তো বটেই। অতবড়ো মেয়ের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হওয়াটা তো ভালো নয়। কিন্তু, বাবা, আজকের আমার এই কাজটি না করে দিয়ে তো তুমি ছাড়া পাবে না। তার পরে আর কখনো যদি তোমাকে ডাকি তখন বোলো।”

গোরা বার বার করিয়া মাথা নাড়িল। আর না, কিছুতে না। শেষ হইয়া গেছে। তাহার বিধাতাকে নিবেদন করা হইয়া গেছে। তাহার শুচিতায় এখন সে আর কোনো চিহ্ন ফেলিতে পারিবে না। সে দেখা করিতে যাইবে না।

হরিমোহিনী যখন গোরার ভাবে বুঝিলেন তাহাকে টলানো সম্ভব হইবে না তখন তিনি কহিলেন, “নিতান্তই যদি না যেতে পার তবে এক কাজ করো বাবা, একটা চিঠি তাকে লিখে দাও।”

গোরা মাথা নাড়িল। সে হইতেই পারে না। চিঠিপত্র নয়।