গোরা
পারিলেন না— চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

গোরা কহিল, “আমার কথা কি আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন? আমি যা দিন-রাত্রি হতে চাচ্ছিলুম অথচ হতে পারছিলুম না, আজ আমি তাই হয়েছি। আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান খৃস্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন। দেখুন, আমি বাংলার অনেক জেলায় ভ্রমণ করেছি, খুব নীচ পল্লীতেও আতিথ্য নিয়েছি— আমি কেবল শহরের সভায় বক্তৃতা করেছি তা মনে করবেন না— কিন্তু কোনোমতেই সকল লোকের পাশে গিয়ে বসতে পারি নি— এতদিন আমি আমার সঙ্গে সঙ্গে একটা অদৃশ্য ব্যবধান নিয়ে ঘুরেছি— কিছুতেই সেটাকে পেরোতে পারি নি। সেজন্যে আমার মনের ভিতরে খুব একটা শূন্যতা ছিল। এই শূন্যতাকে নানা উপায়ে কেবলই অস্বীকার করতে চেষ্টা করেছি— এই শূন্যতার উপরে নানাপ্রকার কারুকার্য দিয়ে তাকেই আরো বিশেষরূপ সুন্দর করে তুলতে চেষ্টা করেছি! কেননা, ভারতবর্ষকে আমি যে প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি— আমি তাকে যে অংশটিতে দেখতে পেতুম সে অংশের কোথাও যে আমি কিছুমাত্র অভিযোগের অবকাশ একেবারে সহ্য করতে পারতুম না। আজ সেই-সমস্ত কারুকার্য বানাবার বৃথা চেষ্টা থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে আমি বেঁচে গেছি পরেশবাবু!”

পরেশ কহিলেন, “সত্যকে যখন পাই তখন সে তার সমস্ত অভাব-অপূর্ণতা নিয়েও আমাদের আত্মাকে তৃপ্ত করে— তাকে মিথ্যা উপকরণ দিয়ে সাজিয়ে তোলবার ইচ্ছা মাত্রই হয় না।”

গোরা কহিল, “দেখুন পরেশবাবু, কাল রাত্রে আমি বিধাতার কাছে প্রার্থনা করেছিলুম যে আজ প্রাতঃকালে আমি যেন নূতন জীবন লাভ করি। এতদিন শিশুকাল থেকে আমাকে যে-কিছু মিথ্যা যে-কিছু অশুচিতা আবৃত করে ছিল আজ যেন তা নিঃশেষে ক্ষয় হয়ে গিয়ে আমি নবজন্ম লাভ করি। আমি ঠিক যে কল্পনার সামগ্রীটি প্রার্থনা করেছিলুম ঈশ্বর সে প্রার্থনায় কর্ণপাত করেন নি— তিনি তাঁর নিজের সত্য হঠাৎ একেবারে আমার হাতে এনে দিয়ে আমাকে চমকিয়ে দিয়েছেন। তিনি যে এমন করে আমার অশুচিতাকে একেবারে সমূলে ঘুচিয়ে দেবেন তা আমি স্বপ্নেও জানতুম না। আজ আমি এমন শুচি হয়ে উঠেছি যে চণ্ডালের ঘরেও আমার আর অপবিত্রতার ভয় রইল না। পরেশবাবু, আজ প্রাতঃকালে সম্পূর্ণ অনাবৃত চিত্তখানি নিয়ে একেবারে আমি ভারতবর্ষের কোলের উপরে ভূমিষ্ঠ হয়েছি— মাতৃক্রোড় যে কাকে বলে এতদিন পরে তা আমি পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি।”

পরেশ কহিলেন, “গৌর, তোমার মাতৃক্রোড়ে তুমি যে অধিকার পেয়েছ সেই অধিকারের মধ্যে তুমি আমাদেরও আহ্বান করে নিয়ে যাও।”

গোরা কহিল, “আজ মুক্তিলাভ করে প্রথমেই আপনার কাছে কেন এসেছি জানেন?”

পরেশ কহিলেন, “কেন?”

গৌর কহিল, “আপনার কাছেই এই মুক্তির মন্ত্র আছে— সেইজন্যেই আপনি আজ কোনো সমাজেই স্থান পান নি। আমাকে আপনার শিষ্য করুন। আপনি আমাকে আজ সেই দেবতারই মন্ত্র দিন, যিনি হিন্দু মুসলমান খৃস্টান ব্রাহ্ম সকলেরই— যাঁর মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে, কোনো ব্যক্তির কাছে, কোনোদিন অবরুদ্ধ হয় না— যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নন, যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।”

পরেশবাবুর মুখের উপর দিয়া একটি ভক্তির গভীর মাধুর্য স্নিগ্ধ ছায়া বুলাইয়া গেল, তিনি চক্ষু নত করিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন।

এতক্ষণ পরে গোরা সুচরিতার দিকে ফিরিল। সুচরিতা তাহার চৌকির উপরে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ছিল।

গোরা হাসিয়া কহিল, “সুচরিতা, আমি আর তোমার গুরু নই। আমি তোমার কাছে এই বলে প্রার্থনা জানাচ্ছি, আমার হাত