তৃতীয় অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
রাজাবাহাদুর মধুসূদন ঘোষালের প্রাসাদে
সকালবেলা বাড়ির ছাদে

মোতির মা। একি দিদি! একি কাণ্ড? এখনো সেই সেজবাতির ঘরে? এখানে কেন ভাই?

কুমুদিনী। আর কোথায় যাব?

মোতির মা। তোমার শোবার ঘরে।

কুমুদিনী। সেখান থেকে আমার নির্বাসন।

মোতির মা। কেন ভাই? দিদি, তুমি ভালোবাসতে পারছ না, নয়? আমার কাছে লুকিয়ো না। আচ্ছা, সত্যি করে বলো তো, কখনো কি ভালোবেসেছ? কাকে ভালোবাসা বলে তুমি জান?

কুমুদিনী। যদি বলি জানি তুমি হাসবে। সূর্য ওঠবার আগে যেমন করে আলো হয়, আমার সমস্ত আকাশ ভরে ভালোবাসা তেমনি করেই জেগেছিল। তুমি দময়ন্তীর কথা পড়েছ। শুভক্ষণে তাঁর বাঁ চোখ নেচেছিল, কিন্তু আগে তো জানতেন না যে নল রাজাকেই তিনি পাবেন ; তবু যাঁকে পাবেন তাঁর জন্যেই সর্বান্তঃকরণের অর্ঘ্য সাজিয়ে রাখলেন। তার পর যখন নল রাজাকে পেলেন তখন মনে হল এইজন্যেই বুঝি তাঁর বাঁ চোখ নেচেছিল। কিন্তু আমার এ কী হল দিদি?

মোতির মা। কী হল দিদি?

কুমুদিনী। আমার স্বপ্নে বোনা জাল কে যেন কঠিন হাতে ছিঁড়ে দিলে। এখন সব জিনিসই কঠিন হয়ে আমার লাগছে। একদিন হয়তো এ সবই সয়ে যাবে। কিন্তু জীবনে কোনোদিন আনন্দ পাব না তো।

মোতির মা। কিছুই বলা যায় না ভাই।

কুমুদিনী। খুব বলা যায়। আমার জীবনটা নির্লজ্জের মতো ফাঁকা হয়ে গেছে। নিজেকে ভোলাবার মতো আড়াল আর কোথাও বাকি নেই। তাই তো ভাবি যে এখন থেকে কেবল কষ্ট পাব, কষ্ট দেব, আর মনে জানব এ সমস্তই আমার নিজের সৃষ্টি।

মোতির মা। তুমি কি বড়োঠাকুরকে ভালোবাসতে পারবে না মনে কর?

কুমুদিনী। পারতুম ভালোবাসতে। মনের মধ্যে এমন কিছু এনেছিলুম যাতে সব জিনিসই পছন্দমতো করে নেওয়া সহজ হত। কিন্তু এখন যেন সে উপায় আর রইল না। মনে হয় আমি যেন পথ ভুলে গেছি! আগে মনে করতুম ভালোবাসাই সহজ। সব স্ত্রী সব স্বামীকে আপনিই ভালোবাসে ; আজ দেখছি ভালোবাসতে পারাটাই সব চেয়ে দুর্লভ, জন্মজন্মান্তরের সাধনায় ঘটে। আচ্ছা, সত্যি করে বলো তো ভাই, সব স্ত্রীই কি স্বামীকে ভালোবাসে?

মোতির মা। ভালো না বাসলেও ভালো স্ত্রী হওয়া যায়। নইলে সংসার চলবে কী করে?

কুমুদিনী। সেই আশ্বাস দাও আমাকে। আর কিছু না হই, ভালো স্ত্রী যেন হতে পারি। পুণ্য তাতেই বেশি। সেইটাই কঠিন সাধনা। স্বামীকে ভালোবাসি নে এ কথা বলা পাপ, ভাবা পাপ! মন তো আমার কিছুতেই এ কথা মেনে নিতে রাজি নয়। কিন্তু কই, তবু তো বুকের মাঝে তাঁকে পাচ্ছি নে যেমন করে পেয়েছিলুম আমার ঠাকুরকে। আচ্ছা, দাদাকে টেলিগ্রাফ করতে বলেছিলুম, করেছ?

মোতির মা। হাঁ, তখনি করেছি।

কুমুদিনী। উত্তর আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন?

মোতির মা। তোমার মনের উদ্‌বেগে দেরি বোধ হচ্ছে।

কুমুদিনী। মন কেন এত ছট্‌ফট্‌ করছে, বলব?