অরসিকের স্বর্গপ্রাপ্তি

(কার্তিকের পার্শ্বে বসিয়া) গুহ, আপনি ভালো আছেন তো? আপনাদের এখানকার মিলিটারি ডিপার্ট্‌মেণ্ট সম্বন্ধে আমার দুটো-একটা খবর নেবার আছে। আপনারা কিরকম নিয়মে— আচ্ছা, তা হলে এখন থাক্‌। আগে আপনাদের অভিনয়টা হয়ে যাক। কেবল একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, এই-যে নাটকটি অভিনয় হচ্ছে এর নাম তো শুনছি ‘চিত্রলেখার বিরহ'; এর উদ্দেশ্যটা কী আমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। উদ্দেশ্য দু রকমের হতে পারে, এক জ্ঞানশিক্ষা, আর-এক নীতিশিক্ষা। কবি, হয় এই গ্রন্থের মধ্যে কোনো-একটা জাগতিক নিয়ম আমাদের সহজে বুঝিয়ে দিয়েছেন, নয় স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, ভালো করলে ভালো হয়, মন্দ করলে মন্দই হয়ে থাকে। ভেবে দেখুন বিবর্তনবাদের নিয়ম-অনুসারে পরমাণুপুঞ্জ কিরকম করে ক্রমে ক্রমে বিচিত্র জগতে পরিণত হল, কিংবা আমাদের ইচ্ছাশক্তি যে অংশে পূর্ববর্তী কর্মের ফল সেই অংশে বদ্ধ এবং যে অংশে পরবর্তী কর্মকে জন্ম দেয় সেই অংশে মুক্ত এই চিরস্থায়ী বিরোধের সামঞ্জস্য কোন্‌খানে— কাব্যে যখন সেই তত্ত্ব পরিস্ফুট হয় তখন কাব্যের উদ্দেশ্যটি হাতে হাতে পাওয়া যায়। চিত্রলেখার বিরহের মধ্যে এর কোন্‌টি আছে? আপনি তো বিগলিতপ্রায় হয়ে এসেছেন; যেরকম দেখছি দেবলোকে যদি ফিজিয়লজির নিয়ম বলে একটা কিছু থাকত তা হলে এখনই আপনার দ্বাদশ চক্ষু থেকে অশ্রুধারা প্রবাহিত হত। যাই হোক কার্তিক, এ বড়ো দুঃখের বিষয়, স্বর্গে আপনাদের রাশি রাশি কাব্য-নাটকের ছড়াছড়ি যাচ্ছে, কিন্তু যাতে গবেষণা কিংবা চিন্তাশীলতার পরিচয় পাওয়া যায় স্বর্গীয় গ্রন্থকারদের হাত থেকে এমন একটা কিছুই বেরোচ্ছে না। ( ঈষৎ হাস্যসহকারে) দেখছি ‘চিত্রলেখার বিরহ' নাটকখানা আপনার বড়োই ভালো লেগে গেছে, তা হলে অন্য প্রসঙ্গ থাক্‌, আপনি ঐটেই দেখুন।

(ইন্দ্রের নিকট গিয়া) দেখুন দেবরাজ, স্বর্গে পরস্পরের মতামত আলোচনার একটা স্থান না থাকাতে বড়োই অভাব বোধ করা যায়। আমার ইচ্ছা নন্দনকাননের পারিজাতকুঞ্জের মধ্যে যেখানে আপনাদের নৃত্যশালা আছে, সেইখানে একটা সভা স্থাপন করি, তার নাম দিই ‘শতক্রতু ডিবেটিং ক্লাব’। তাতে আপনারও একটা নাম থাকবে আর স্বর্গেরও অনেক উপকার হবে। না, থাক্‌, মাপ করবেন— আমার অভ্যাস নেই— আমি অমৃত খাই নে— রাগ যদি না করেন তো বলি, ও অভ্যাসটা আপনাদের ত্যাগ করা উচিত। আমি দেখেছি, দেবতাদের মধ্যে পানদোষটা কিছু প্রবল হয়েছে। অবশ্য, ওটাকে আপনারা সুরা বলেন না, কিন্তু বললে কিছু অত্যুক্তি হয় না। পৃথিবীতেও দেখতুম অনেকে মদকে ওআইন বলে কিছু সন্তোষলাভ করতেন। সুরেন্দ্র, আপনি শ্রীমতি মেনকাকে এইমাত্র যে সম্বোধনটা করলেন ওটা কি ভালো শুনতে হল? সংস্কৃত কাব্যে নাটকে দেখেছি বটে ঐ-সকল সম্বোধন প্রচলিত ছিল, কিন্তু আপনি যদি বিশ্বস্তসূত্রে খবর নেন তো জানতে পারবেন, ওগুলো এখন নিন্দনীয় বলে গণ্য হয়েছে। আমরা কিরকম সম্বোধন করি জানতে চাচ্ছেন? আমরা কখনো মাতৃসম্বোধনও করে থাকি, কখনো-বা বাছাও বলি, আবার সময়-বিশেষে ভালোমানুষের মেয়ে বলেও সম্ভাষণ করা যেতে পারে। এর মধ্যে কোনোটিই আপনি এই-সকল মহিলাদের প্রতি প্রয়োগ করতে ইচ্ছা করেন না? তা না করুন, এটা স্বীকার করতেই হবে আপনারা ওঁদের সম্বন্ধে যে বিশেষণগুলি উচ্চারণ করে থাকেন, তাতে রুচির পরিচয় পাওয়া যায় না। কী বললেন? স্বর্গে সুরুচিও নেই, কুরুচিও নেই? প্রথমটি যে নেই সে বিষয়ে সন্দেহ করি নে; দ্বিতীয়টি যে আছে তা এখনই প্রমাণ করে দিতে পারি, কিন্তু আপনারা তো আমার কোনো আলোচনাতেই কর্ণপাত করেন না।

(শচীর নিকট গিয়া) দেখুন শচী, আপনার কি মনে হয় না, স্বর্গসমাজের ভিতরে যে-সমস্ত দোষ প্রবেশ করেছে সেগুলো দূর করবার জন্যে আমাদের বদ্ধপরিকর হওয়া উচিত? আপনারা স্বর্গাঙ্গনারাও যদি এ-সকল বিষয়ে শৈথিল্য প্রকাশ করতে থাকেন তা হলে আপনাদের স্বামীদের চরিত্রের অবস্থা ক্রমশই শোচনীয় হতে থাকবে। ওঁদের সম্বন্ধে যে-সকল অপযশের কথা প্রচলিত আছে সে আপনাদের অবিদিত নেই; মধ্যে মধ্যে যদি সভা আহ্বান করে এ-সকল বিষয়ে আলোচনা হয়, আপনারা যদি সাহায্য করেন, তা হলে— কোথায় যান? গৃহকর্ম আছে বুঝি? ( শচীকে উঠিতে দেখিয়া সকল দেবতার উত্থান এবং অকালে সভাভঙ্গ)। মহা মুশকিলে পড়া গেল! কাউকে একটা কথা বললে কেউ শোনেও না, বুঝতেও পারে না। ( ইন্দ্রের নিকট গিয়া কাতর স্বরে) ভগবন্‌