রাজা ও রানী

ত্রিবেদী। তোমরা বড়োলোক, তোমাদের এইরকমই হয়। নইলে ‘ধর্মস্য সূক্ষ্মা গতি' বলবে কেন? যদি তোমাদের কেউ এসে বলে, ‘আয় তো রে পাষণ্ড, তোর মুণ্ডুটা টান মেরে ছিঁড়ে ফেলি ’ অমনি তোমাদের উপলুব্ধ হয় যে, আর যাই হোক লোকটা প্রবঞ্চনা করছে না, মুণ্ডুটার উপরে বাস্তবিক তার নজর আছে বটে। কিন্তু যদি কেউ বলে, ‘এসো তো বাপধন, আস্তে আস্তে তোমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিই', অমনি তোমাদের সন্দেহ হয়। যেন আস্ত মুণ্ডুটা ধরে টান মারার চেয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়া শক্ত কাজ! হে ভগবান, যদি রাজা স্পষ্ট করেই বলত — একবার হাতের কাছে এস তো, তোমাদের এক-একটাকে ধরে রাজ্য থেকে নির্বাসন করে পাঠাই — তা হলে এটা কখনো সন্দেহ করতে না যে, হয়তো-বা রাজকন্যার সঙ্গে পরিণাম-বন্ধন করবার জন্যেই রাজা ডেকে থাকবেন। কিন্তু রাজা বলছেন নাকি, ‘হে বন্ধুসকল, রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্ঠতি স বান্ধব, অতএব তোমরা পুজো উপলক্ষে এখানে এসে কিঞ্চিৎ ফলাহার করবে' — অমনি তোমাদের সন্দেহ হয়েছে, সে ফলাহারটা কী রকমের না জানি। হে মধুসূদন! তা এমনি হয় বটে। বড়োলোকের সামান্য কথায় সন্দেহ হয়, আবার সামান্য লোকের বড়ো কথায় সন্দেহ হয়।

জয়সেন। ঠাকুর, তুমি অতি সরল প্রকৃতির লোক। আমার যেটুকু বা সন্দেহ ছিল, তোমার কথায় সমস্ত ভেঙে গেছে।

ত্রিবেদী। তা লেহ্য কথা বলেছ। আমি তোমাদের মতো বুদ্ধিমান নই, সকল কথা তলিয়ে বুঝতে পারি নে ; কিন্তু বাবা, সরল — পুরাণ-সংহিতায় যাকে বলে, ‘অন্যে পরে কা কথা', অর্থাৎ, অন্যের কথা নিয়ে কখনো থাকি নে।

জয়সেন। আর কাকে কাকে তুমি নিমন্ত্রণ করতে বেরিয়েছ?

ত্রিবেদী। তোমাদের পোড়া নাম আমার মনে থাকে না। তোমাদের কাশ্মীরী স্বভাব যেমন তোমাদের নামগুলোও ঠিক তেমনি শ্রুতিপৌরুষ। তা এ রাজ্যে তোমাদের গুষ্টির যেখানে যে আছে সকলকেই ডাক পড়েছে। শূলপাণি! কেউ বাদ যাবে না।

জয়সেন। যাও ঠাকুর, এখন বিশ্রাম করো গে।

ত্রিবেদী। যা হোক, তোমার মন থেকে যে সমস্ত সন্দেহ দূর হয়েছে, মন্ত্রী একথা শুনলে ভারি খুশি হবে। মুকুন্দ মুরহর মুরারে!

[ প্রস্থান

জয়সেন। মিহিরগুপ্ত, সমস্ত অবস্থা বুঝলে তো? এখন গৌরসেন যুধাজিৎ উদয়ভাস্কর ওদের কাছে শীঘ্র লোক পাঠাও। বলো, অবিলম্বে সকলে একত্র মিলে একটা পরামর্শ করা আবশ্যক।

মিহিরগুপ্ত। যে আজ্ঞা।


দ্বিতীয় দৃশ্য
অন্তঃপুর
বিক্রমদেব ও রানীর আত্মীয় সভাসদ

  সভাসদ।  ধন্য মহারাজ!

বিক্রমদেব।               কেন এত ধন্যবাদ?

  সভাসদ। মহত্ত্বের এই তো লক্ষণ, দৃষ্টি তার