পরিশিষ্ট
অসম্পূর্ণ। আমরা যখন কোনো বস্তুর এক পিঠ দেখি তখন অন্য পিঠ দেখিতে পাই না, যখন বাহিরটা দেখি তখন ভিতরটা আমাদের অগোচর থাকে। অধিকক্ষণ কিছু অনুভব করিতে গেলে আমাদের ইন্দ্রিয় ক্লান্ত, আমাদের স্নায়ুশক্তি অসাড় হইয়া আসে।

কিন্তু তথাপি জড়বস্তুসকলকে আমরা পাইলাম বলিয়া সন্তুষ্ট আছি; এবং যে বস্তুকে যে উপায়ে যে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা পাওয়া সম্ভব সেই উপায়ে সেই ইন্দ্রিয়ের দ্বারাই তাহাকে লাভ করিবার চেষ্টা করিয়া থাকি।

লৌকিক বস্তু সম্বন্ধেই যখন এরূপ তখন নিরাকার ব্রহ্মকে পাওয়ারই কি কোনো বিশেষত্ব নাই? তাঁহাকে চোখে দেখিলাম না বলিয়াই কি তাঁহাকে পাইলাম না?

এ কথা আমরা কেন না মনে করি যে, স্বরূপতই তিনি যখন চোখে দেখার অতীত তখন তাঁহাকে চোখে দেখার চেষ্টা করাই মূঢ়তা। আমরা যদি আলোককে সংগীতরূপে ও সংগীতকে গন্ধরূপে পাইবার কল্পনাকেও দুরাশা বলিয়া জ্ঞান করি তবে নিরাকারকে সাকাররূপে লাভ না করিলে তাঁহাকে লাভ করাই হইল না এ কথা কেমন করিয়া মনে স্থান দিই?

আমরা যখন টাকা হাতে পাই তাহাকে কি আমাদের অন্তরাত্মার মধ্যে তুলিয়া রাখিতে পারি? যে ব্যক্তি তাহাকে অত্যন্ত নিজের করিয়া রাখিতে চেষ্টা করে সে তাহাকে মাটিতে পুতিয়া ফেলে, লোহার সিন্দুকে পুরিয়া রাখে, নিজের করিতে গিয়া নিজের কাছ হইতে দূরেই তাহাকে রাখিতে হয়। কিন্তু একান্ত চেষ্টাতেও সে টাকাকে কৃপণ আপনার অন্তরের মধ্যে রাখিতে পারে না; বাহিরের টাকা বাহিরেই পড়িয়া থাকে এবং মৃত্যুকালে ধূলির সহিত তাহার কোনো প্রভেদ থাকে না। কৃপণ তবুও তো জানে টাকা আমার, টাকা আমি পাইয়াছি। বাহিরের ধনকে অন্তরে না পাইয়াও আমরা তাহাকে পাইলাম বলিয়া স্বীকার করি; আর যিনি আমাদের একমাত্র ধন, যিনি অন্তরের অন্তরতম, তাঁহাকে বস্তুরূপে মূর্তিরূপে মনুষ্যরূপে বাহিরে না পাইলে কি আমাদের পাওয়া হইল না? যিনি চক্ষুষশ্চক্ষুঃ, চক্ষুর চক্ষু, তাঁহাকে কি চক্ষুর বাহিরে দেখিব? যিনি শ্রোত্রস্য শ্রোত্রং, কর্ণের কর্ণ, তাঁহাকে কি কর্ণের বাহিরে শুনিব? যাঁহার সম্বন্ধে ঋষি বলিয়াছেন –

ন সন্দৃশে তিষ্ঠতি রূপমস্য

ন চক্ষুষা পশ্যতি কশ্চনৈনং।

হৃদা মনীষা মনসাভিক্‌প্তো

য এনমেবং বিদুরমৃতাস্তে ভবন্তি॥

ইঁহার স্বরূপ চক্ষুর সম্মুখে স্থিত নহে, ইঁহাকে কেহ চক্ষুতে দেখে না– হৃদিস্থিত বুদ্ধি দ্বারা ইনি কেবল হৃদয়েই প্রকাশিত, ইঁহাকে যাঁহারা এইরূপেই জানেন তাঁহারা অমর হন– এমন-যে আত্মার অন্তরাত্মা তাঁহাকে বহির্বস্তুর মতো বাহিরে পাইতে গেলেই তাঁহাকে পাওয়া যায় না এ কথা আমরা কেন না স্মরণ করি?

যাঁহারা ঈশ্বরকে পাইবার চেষ্টা করিয়াছেন তাঁহারা কী বলিয়াছেন? তাঁহারা বলেন –

ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্র তারকং

নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোহয়মগ্নিঃ।

সূর্য তাঁহাকে প্রকাশ করিতে পারে না, চন্দ্রতারাও তাঁহাকে প্রকাশ করিতে পারে না, এই বিদ্যুৎসকলও তাঁহাকে প্রকাশ করিতে পারে না, তবে এই অগ্নি তাঁহাকে কী প্রকারে প্রকাশ করিবে?

তাঁহারা বলেন –

তমাত্মস্থং যে অনুপশ্যন্তি ধীরাঃ

তেষাং শান্তিঃ শাশ্বতী নেতরেষাম্‌।