ম্যালেরিয়া
রোগ-তাপ-দুঃখে ক্লিষ্ট, জয়স্তম্ভ থাকবে না, কাত হয়ে পড়ে যাবে, একে রক্ষা করতে পারবে না, ধীরে ধীরে চেষ্টা করতে হবে নইলে টিঁকবে না। দুর্বলতা এক রূপে না এক রূপে আপনাকে প্রকাশ করবে। দুর্বলতার একটা কুশ্রী আকার আছে। সে হচ্ছে, আর-একজন গিয়ে সফলতা লাভ করবে, বড়ো কাজ করবে, এতে দুর্বলের মনে ঈর্ষা হয়— কী করে তাকে ছোটো করা যায় প্রাণপণে সে চেষ্টা করে। আমি কারো দোষ দিই না। পিলে যকৃৎ ভিতরে বড়ো হলে হৃদয় বড়ো হতে পারে না। পিলে বড়ো হয়েছে, যকৃৎ বড়ো হয়েছে, অন্তরে তারা জায়গা করেছে, হৃদয়ের জায়গা ছোটো, এইজন্য বরাবর দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশে সকলের চেয়ে বড়ো... কর্মী নিজে, আর কেহ নয়। মনে শান্তি নাই, তার কারণ ভিতরকার ঈর্ষা। যে নিজে কিছু করতে পারছে না তার ভিতরে মাৎসর্য ফুটে ওঠে। আমি পারছি না, অমুক পারছে, চেষ্টা করছে, তখন ‘ওর নাড়ীনক্ষত্র আমি জানি ' এ কথা বললে অন্তকরণ শান্ত হয়— সুস্থ হয়। আমাদের দেশে এমন কর্মী কেহ নাই যার সম্বন্ধে আমরা এইরকম ভাব কোনো-না-কোনো আকারে মনে পোষণ না করে থাকি, তার কীর্তি কিছু-না-কিছু খর্ব না করতে চাই। এর কারণ সেই ম্যালেরিয়ার ভিতরে— দেহের শক্তি মনের শক্তিকে নষ্ট করেছে। তা হলে আপনারা বলতে পারেন, ‘আগে দেহে শক্তি সঞ্চয় করুন। ' তা নয়, মানুষকে ভাগ করা যায় না; দেহ মন আত্মায় সে এক, আগে এইটে পরে ঐটে বলা চলে না। মনে জোর দিলে দেহে জোর পাই, দেহে জোর দিলে মনে জোর পাই, আবার দেহমনে জোর দিলে ধীশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়— দেহ মন আত্মা একসঙ্গে গাঁথা। যে মন্ত্রে দেহের রোগ দূর হবে সে মন্ত্রে মনের যে দীনতা পরিনির্ভরতা তাও দূর হবে। আমার পূর্ববতী বক্তা বলেছেন, এই-যে রেলওয়ে হয়েছে, ফলে জল-নিকাশের পথ বন্ধ হয়েছে— মস্ত মস্ত কারবারী লোক, তারা কিভাবে আমাদের দিকে তাকায় কী দুঃখ আমরা ভোগ করছি তারা কি সেটা বোঝে। বন্যায় দেশ ভেসে যাচ্ছে তার একমাত্র কারণ, তারা লাভের উপর লাভ করে যাচ্ছে, গলা পর্যন্ত যারা লাভ করেছে তাদের পরিত্রাণের আশা নাই। তারা এইসমস্ত রেলওয়ে লাইন খুলছে। আমরা কে। আমরা ‘থামো থামো ' বললেই কি রেলওয়ে থামবে। না ক্রমাগত বুকের উপর দিয়ে চলে যাবে? মস্ত মস্ত কারবারী তারা এই-সমস্ত করছে, আমরা কেঁদে কী করব। তবে কী হবে। সমস্ত গ্রামের লোক যদি বোঝে আমরা কেউ কিছু নয়, এটা নয়; যখন তারা বুঝবে এই কো-অপারেটিভ সোসাইটি একটা মস্ত বড়ো জিনিস— ইচ্ছা করলে সকলে মিলে মিশে মরতে পারে, তখন তারা সকলে মিলে এই দুর্গতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, সকলে কণ্ঠ তুলে বলতে পারে, ‘ভাঙব তোমার রেলওয়ে লাইন। আমরা মরব আর তোমরা লাভ করবে? এখন বলতে পারবে না। ( আপনারা করতালি দেবেন না। ) এর জন্যে অনেক ভিত্তি গাড়তে হবে, অনেক দূর গভীর করে— এটা সকলের চেয়ে বড়ো কাজ। আমি অনেকবার বলেছি— কবি বলে আমার কথা শোনে নাই— আমি বলেছি সমাজের ভিতর থেকে সমাজের শক্তিকে জাগাতে হবে, পরস্পর সকলের সমবেত চেষ্টা-দ্বারা শক্তি লাভ করবে। এ সম্বন্ধে চেষ্টাও করেছি, পল্লী-সমিতি বলে সমিতি গড়ে তুলেছি, এ বিষয়ে আমার মাথা ততটা খেলাতে পারি নাই। আজ দেখে আনন্দ হয়েছে— এতদিনে আমরা বুঝতে পেরেছি কোন্‌ জায়গায় আমাদের গলদ। গগনস্পর্শী পার্লিয়ামেন্ট্‌ হলে হবে না। আমাদের অভাব এখানে নয়। আমাদের অভাব ভিতরে— যার উপর গড়তে পারব। একবার মুষ্টিমেয় কলেজে-পড়া উপাধিধারী কয়েকজন ভেবেছিল, ‘আমাদের চেষ্টার উপর উদ্যমের উপর দাঁড় করাতে পারব। ' মরে গিয়েছে— সমস্ত দেশ ক্রমে ক্রমে জীবন্মৃত হয়েছে তা নয়— যথার্থ মরেছে। সেদিন আমাদের একদল লোক চিত্রকলা অভ্যাস করতে গ্রামের চিত্রকলা দেখতে গিয়েছিল। তারা এসে বললে, ‘আমাদের আর অন্নে রুচি হয় না; দেখলাম একেবারে উজাড় হয়েছে— একটা গ্রামে, বড়ো গ্রামে, বড়ো বড়ো বাড়ি পড়ে রয়েছে। চার ঘর কায়স্থ রয়েছে। এখনো বেঁচে আছে কী করে জিজ্ঞাসা করায় বলল, আমরা বৎসরের মধ্যে দুবার আসানসোল কি বর্ধমানে গিয়ে সম্‌বৎসরের কাপড়-চোপড় নিয়ে আসি। যে কয়দিন বেঁচে আছি এমনি ভাবে যাবে, যখন মৃত্যুর পরওয়ানা আসবে যাব। এক জায়গায় দেখলাম— সমস্ত বড়ো বাড়ি। যারা ৫০। ১০০ বৎসর পূর্বে বর্ধিষ্ণু লোক ছিল এখন সেখানে তাদের রথ পড়ে আছে, দেবতা অচল। ' এইটা শুনাব না মনে করেছিলাম। আপনাদের মধ্যে অনেকে ধর্মপ্রাণ আছেন, তাঁরা বলবেন, ‘আমরা গিয়ে দেবতার রথ চালাব। ' আমি বলি সে