সরোজিনী-প্রয়াণ
ভাবিলে বোধ করি মাথা ঠিক রাখিতে পারি না। কত পুঁথি, কত চটি, কত যশ, কত কলঙ্ক, কত জ্ঞান, কত পাগলামি, কত ফাঁসির হুকুম, যুদ্ধের ঘোষণা, প্রেমের লিপি কালো কালো হইয়া স্রোত বাহিয়া বাহির হইতেছে। ঐ স্রোত যখন সমস্ত জগতের উপর দিয়া বহিয়া গিয়াছে–তখন–দূর হউক কালি যে ক্রমেই গড়াইতে চলিল, স্টীফেন সাহেবের সমস্ত কারখানাটাই দৈবাৎ যেন উল্টাইয়া পড়িয়াছে-এবার ব্লটিং কাগজের কথা মনে পড়িতেছে। স্রোত ফিরানো যাক। এসো, এবার গঙ্গার স্রোতে এসো।

সত্য ঘটনায় ও উপন্যাসে প্রভেদ আছে তাহার সাক্ষ্য দেখো, আমাদের জাহাজ বয়ায় ঠেকিল, তবু ডুবিল না –পরম বীরত্ব-সহকারে কাহাকেও উদ্ধার করিতে হইল না –প্রথম পরিচ্ছেদে জলে ডুবিয়া মরিয়া ষড়্‌বিংশ পরিচ্ছেদে কেহ ডাঙায় বাঁচিয়া উঠিল না। না ডুবিয়া সুখী হইয়াছি সন্দেহ নাই, কিন্তু লিখিয়া সুখ হইতেছে না। পাঠকেরা নিশ্চয়ই অত্যন্ত নিরাশ হইবেন; কিন্তু আমি যে ডুবি নাই সে আমার দোষ নয়, নিতান্তই অদৃষ্টের কারখানা। অতএব আমার প্রতি কেহ না রুষ্ট হন এই আমার প্রার্থনা।

মরিলাম না বটে, কিন্তু যমরাজের মহিষের কাছ হইতে একটা রীতিমত ঢুঁ খাইয়া ফিরিলাম। সুতরাং সেই ঝাঁকানির কথাটা স্মরণফলকে খদিত হইয়া রহিল। খানিকক্ষণ অবাকভাবে পরস্পরের মুখ-চাওয়া-চাওয়ি করা গেল–সকলেরই মুখে এক ভাব, সকলেই বাক্যব্যয় করা নিতান্ত বাহুল্য জ্ঞান করিলেন। বউঠাকরুন বৃহৎ একটা চৌকির মধ্যে কেমন একরকম হইয়া বসিয়া রহিলেন। তাঁহার দুইটি ক্ষুদ্র আনুষঙ্গিক আমার দুই পার্শ্ব জড়াইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। দাদা কিয়ৎক্ষণ ঘন ঘন গোঁফে তা দিয়া কিছুই সিদ্ধান্ত করিতে পারিলেন না। কর্তাবাবু রুষ্ট হইয়া বলিলেন, সমস্তই মাঝির দোষ; মাঝি কহিল, তাহার অধীনে যে ব্যক্তি হাল ধরিয়াছিল তাহার দোষ; সে কহিল, হালের দোষ। হাল কিছু না বলিয়া অধোবদনে সটান জলে ডুবিয়া রহিল, গঙ্গা দ্বিধা হইয়া তাহার লজ্জা রক্ষা করিলেন।

এইখানেই নোঙর ফেলা হইল। যাত্রীদের উৎসাহ দেখিতে দেখিতে হ্রাস পাইয়া গেল; সকালবেলায় যেমনতরো মুখের ভাব, কল্পনার এঞ্জিন-গঞ্জন গতি ও আওয়াজের উৎকর্ষ দেখা গিয়াছিল, বিকালে ঠিক তেমনটি দেখা গেল না। আমাদের উৎসাহ নোঙরের সঙ্গে সঙ্গে সাত হাত জলের নীচে নামিয়া পড়িল। একমাত্র আনন্দের বিষয় এই ছিল যে, আমাদিগকে অতদূর নামিতে হয় নাই। কিন্তু সহসা তাহারই সম্ভাবনা সম্বন্ধে চৈতন্য জন্মিল। এ সম্বন্ধে আমরা যতই তলাইয়া ভাবিতে লাগিলাম ততই আমাদের তলাইবার নিদারুণ সম্ভাবনা মনে মনে উদয় হইতে লাগিল। এইসময় দিনমণি অস্তাচলচুড়াবলম্বী হইলেন। বরিশালে যাইবার পথ অপেক্ষা বরিশালে না-যাইবার পথ অত্যন্ত সহজ ও সংক্ষিপ্ত, এ বিষয়ে চিন্তা করিতে করিতে দাদা জাহাজের ছাতের উপর পায়চারি করিতে লাগিলেন। একটা মোটা কাছির কুণ্ডলীর উপর বসিয়া এই ঘনীভূত অন্ধকারের মধ্যে হাস্যকৌতুকের আলো জ্বালাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম, কিন্তু বর্ষাকালের দেশলাই-কাঠির মতো সেগুলা ভালো করিয়া জ্বলিল না। অনেক ঘর্ষণে থাকিয়া থাকিয়া অমনি একটু একটু চমক মারিতে লাগিল। যখন সরোজিনী জাহাজ তাঁহার যাত্রীসমেত গঙ্গাগর্ভের পঙ্কিল বিশ্রামশয্যায় চতুর্বর্গ লাভ করিয়াছেন তখন খবরের কাগজে sad accident- এর কোঠায় একটিমাত্র প্যারাগ্রাফে চারিটিমাত্র লাইনের মধ্যে কেমন সংক্ষেপে নির্বাণমুক্তি লাভ করিব সে বিষয়ে নানা কথা অনুমান করিতে লাগিলাম। এই সংবাদটি এক চামচ গরম চায়ের সহিত অতি ক্ষুদ্র একটি বটিকার মত কেমন অবাধে পাঠকদের গলা দিয়া নামিয়া যাইবে, তাহা কল্পনা করা গেল। বন্ধুরা বর্তমান লেখকের সম্বন্ধে বলিবেন, ‘আহা, কত বড়ো মহদাশয় লোকটাই গেছেন গো, এমন আর হইবে না। ' এবং লেখকের পূজনীয়া ভ্রাতৃজায়া সম্বন্ধে বলিবেন, ‘আহা, দোষে গুণে জড়িত মানুষটা ছিল, যেমন তেমন হোক তবু তো ঘরটা জুড়ে ছিল। ' ইত্যাদি ইত্যাদি। জাঁতার মধ্য হইতে যেমন বিমল শুভ্র ময়দা পিষিয়া বাহির হইতে থাকে, তেমনি বউঠাকুরাণীর চাপা ঠোঁটজোড়ার মধ্য হইতে হাসিরাশি ভাঙিয়া বাহির হইতে লাগিল।

আকাশে তারা উঠিল, দক্ষিণে বাতাস বহিতে লাগিল। খালাসিদের নমাজ পড়া শেষ হইয়া গিয়াছে। একজন খ্যাপা খালাসি তাহার তারের যন্ত্র বাজাইয়া, এক মাথা কোঁকড়া-ঝাঁকড়া চুল নাড়াইয়া, পরমউৎসাহে গান গাহিতেছে। ছাতের উপরে বিছানায় যে