গ্রাম্যসাহিত্য
গিরিরানী কন বাণী চুমো দিয়ে মুখে
কও তারিণী জামাই-ঘরে ছিলে কেমন সুখে॥

এ ছড়াটি এইখানে শেষ হইল, ইহার বেশি আর বলিবার কথা নাই। এ দিকে বিদায়ের কাল সমাগত। কন্যাকে লইয়া শ্বশুরঘরের সহিত বাপের ঘরের একটু ঈর্ষার ভাব থাকে। বেশিদিন বধূকে বাপের বাড়িতে রাখা শ্বশুরপক্ষের মনঃপূত নহে। বহুকাল পরে মাতায় কন্যায় যথেষ্ট পরিতৃপ্তিপূর্বক মিলন হইতে না হইতেই শ্বশুরবাড়ি হইতে তাগিদ আসে, ধন্না বসিয়া যায়। স্ত্রীবিচ্ছেদবিধুর স্বামীর অধৈর্য তাহার কারণ নহে। হাজার হউক, বধূ পরের ঘর হইতে আসে; শ্বশুরঘরের সহিত তাহার সম্পূর্ণ জোড় লাগা বিশেষ চেষ্টার কাজ। সেখানকার নূতন কর্তব্য অভ্যাস ও পরিচয়বন্ধন হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া তাহার বাল্যকালের স্বাভাবিক আশ্রয়স্থলে ঘন ঘন যাতায়াত বা দীর্ঘকাল অবস্থিতি করিতে দিলে জোড় লাগিবার ব্যাঘাত করে। বিশেষত বাপের বাড়িতে বিবাহিতা কন্যার কেবলই কর্তব্যহীন আদর, শ্বশুরবাড়িতে তাহার কর্তব্যের শাসন, এমন অবস্থায় দীর্ঘকাল বাপের বাড়ির আবহাওয়া শ্বশুরবর্গ বধূর পক্ষে প্রার্থনীয় জ্ঞান করেন না। এই-সকল নানা কারণে পিতৃগৃহে কন্যার গতিবিধিসম্বন্ধে শ্বশুরপক্ষীয়ের বিধান কিছু কঠোর হইয়াই থাকে। কন্যাপিতৃত্বের সেই একটা কষ্ট। বিজয়ার দিন বাংলাদেশের শ্বশুরবাড়ির সেই কড়া তাগিদ লইয়া শিব মেনকার দ্বারে আসিয়া উপস্থিত। মাতৃস্নেহের স্বাভাবিক অধিকার সমাজ-শাসনের বিরুদ্ধে বৃথা আছাড় খাইয়া মরিতে লাগিল।

নাহি কাজ গিরিরাজ, শিবকে বলো যেয়ে
অমনি ভাবে ফিরে যাক সে, থাকবে আমার মেয়ে॥

তখন, শ্বশুরবাড়িতে দুর্গার যত কিছু দুঃখ আছে সমস্ত মাতার মনে পড়িতে লাগিল। শিবের ভাণ্ডারে যত অভাব, আচরণে যত ত্রুটি, চরিত্রে যত দোষ, সমস্ত তাঁহার নিকট জাজ্বল্যমান হইয়া উঠিল। অপাত্রে কন্যাদান করিয়াছেন, এখন সেটা যতটা পারেন সংশোধন করিবার ইচ্ছা, যতটা সম্ভব গৌরীকে মাতৃক্রোড়ে ফিরাইয়া লইবার চেষ্টা। শ্বশুরগৃহের আচারবিচার অনেক সময় দূর হইতে পিতৃগৃহের নিকট অযথা বলিয়া মনে হয় এবং পিতৃপক্ষীয়েরা স্নেহের আক্ষেপে কন্যার সমক্ষেই তাহার কঠোর সমালোচনা করিয়া থাকেন। মেনকা তাই শুরু করিলেন, এবং শিব সেই অন্যায় আচরণে ক্ষিপ্ত হইয়া শ্বশুরবাড়ির অনুশাসন সতেজে প্রচার করিয়া দিলেন।

মর্তে আসি পূর্বকথা ভুলছ দেখি মনে।
বারে বারে নিষেধ তোমায় করছি এ কারণে।
মায়ের কোলে মত্ত হয়ে ভুলছ দেখি স্বামী।
তোমার পিতা কেমন রাজা তাই দেখব আমি॥
শুনে কথা গিরিরাজা উষ্মাযুক্ত হল।
জয়-জোগাড়ে অভয়ারে যাত্রা করে দিল॥
যে নিবে সে ক’তে পারে, নইলে এমন শক্তি কার।
যাও তারিণী হরের ঘরে, এসো পুনর্বার॥

অনুগ্রহের সংকীর্ণ মেয়াদ উত্তীর্ণ হইল, কন্যা পতিগৃহে ফিরিয়া গেল।

এক্ষণে যে ছড়ার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতেছি তাহাতে দেবদেবীর একটি গোপন ঘরের কথা বর্ণিত আছে।

শিব সঙ্গে রসরঙ্গে বসিয়ে ভবানী।
কুতূহলে উমা বলেন ত্রিশূল শূলপাণি॥