অচলায়তন

দাদাঠাকুর। আমিও যে ওদের সঙ্গে খেলে বেড়াই সে খেলা আমার কাছে মস্ত খেলা। আমার মনে হয় আমি ঝরনার ধারার সঙ্গে খেলছি, সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে খেলছি।

পঞ্চক। তোমার কাছে সবই বড়ো হয়ে গিয়েছে।

দাদাঠাকুর। না ভাই, বড়ো হয় নি, সত্য হয়ে উঠেছে —সত্য যে বড়োই, ছোটোই তো মিথ্যা।

পঞ্চক। তোমার বাধা কেটে গেছে দাদাঠাকুর, সব বাধা কেটে গেছে। এমন হাসতে খেলতে, মিলতে মিশতে, কাজ করতে, কাজ ছাড়তে কে পারে! তোমার ঐ ভাব দেখে আমার মনটা ছট্‌ফট্‌ করতে থাকে। ঐ যে কী একটা আছে—চরম, না পরম, না কী, তা কে বলবে—তার জন্যে দিনরাত যেন আমার মন কেমন করে। থেকে থেকে এক-একবার চমকে উঠি, আর ভাবি এইবার বুঝি হল, বুঝি পাওয়া গেল। দাদাঠাকুর, শুনছি আমাদের গুরু আসবেন।

দাদাঠাকুর। গুরু! কী বিপদ। ভারি উৎপাত করবে তা হলে তো।

পঞ্চক। একটু উৎপাত হলে যে বাঁচি। চুপচাপ থেকে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছে।

দাদাঠাকুর। তোমার যে শিক্ষা কাঁচা রয়েছে, মনে ভয় হচ্ছে না?

পঞ্চক। আমার ভয় সব-চেয়ে কম—আমার একটি ভুলও হবে না।

দাদাঠাকুর। হবে না?

পঞ্চক। একেবারে কিছুই জানি নে, ভুল করবার জায়গাই নেই। নির্ভয়ে চুপ করে থাকব।

দাদাঠাকুর। আচ্ছা বেশ, তোমার গুরু এলে তাঁকে দেখে নেওয়া যাবে। এখন তুমি আছ কেমন বলো তো।

পঞ্চক। ভয়ানক টানাটানির মধ্যে আছি ঠাকুর। মনে মনে প্রার্থনা করছি গুরু এসে যেদিকে হোক একদিকে আমাকে ঠিক করে রাখুন—হয় এখানকার খোলা হাওয়ার মধ্যে অভয় দিয়ে ছাড়া দিন, নয় তো খুব কষে পুঁথি চাপা দিয়ে রাখুন; মাথা থেকে পা পর্যন্ত আগাগোড়া একেবারে সমান চ্যাপটা হয়ে যাই।

দাদাঠাকুর। তা, তোমার গুরু তোমার উপর যত পুঁথির চাপই চাপান না কেন, তার নীচের থেকে তোমাকে আস্ত টেনে বের করে আনতে পারব।

পঞ্চক। তা তুমি পারবে সে আমি জানি। কিন্তু দেখো ঠাকুর, একটা কথা তোমাকে বলি—অচলায়তনের মধ্যে ঐ- যে আমরা দরজা বন্ধ করে আছি, দিব্যি আছি। ওখানে আমাদের সমস্ত বোঝাপড়া একেবারে শেষ হয়ে গেছে। ওখানকার মানুষ সেইজন্যে বড়ো নিশ্চিন্ত। কিছুতে কারও একটু সন্দেহ হবার জো নেই। যদি দৈবাৎ কারও মনে এমন প্রশ্ন ওঠে যে, আচ্ছা ওই যে চন্দ্রগ্রহণের দিনে শোবার ঘরের দেওয়ালে তিনবার সাদা ছাগলের দাড়ি বুলিয়ে দিয়ে আওড়াতে হয় “হুন হুন তিষ্ঠ তিষ্ঠ বন্ধ বন্ধ অমৃতের হূঁ ফট স্বাহা” এর কারণটা কী— তা হলে কেবলমাত্র চারটে সুপুরি আর এক মাষা সোনা হাতে করে যাও তখনই মহাপঞ্চকদাদার কাছে, এমনি উত্তরটি পাবে যে আর কথা সরবে না। হয় সেটা মানো, নয় কানমলা খেয়ে বেরিয়ে যাও, মাঝে অন্য রাস্তা নেই। তাই সমস্তই চমৎকার সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু ঠাকুর, সেখান থেকে বের করে তুমি আমাকে এই যে জায়গাটাতে এনেছ এখানে কোনো মহাপঞ্চকদাদার টিকি দেখবার জো নেই—বাঁধা জবাব পাই কার কাছে। সব কথারই বারো আনা বাকি থেকে যায়। তুমি এমন করে মনটাকে উতলা করে দিলে—তার পর?

দাদাঠাকুর। তার পর?