দেশীয় রাজ্য

দেশভেদে জলবায়ু ও প্রাকৃতিক অবস্থার প্রভেদ হইয়া থাকে, এ কথা সকলেই জানেন। সেই ভেদকে স্বীকার না করিলে কাজ চলে না। যাহারা বিলখালের মধ্যে থাকে তাহারা মৎস্যব্যবসায়ী হইয়া উঠে; যাহারা সমুদ্রতীরের বন্দরে থাকে তাহারা দেশবিদেশের সহিত বাণিজ্যে প্রবৃত্ত হয়; যাহারা সমতল উর্বরা ভূমিতে বাস করে তাহারা কৃষিকে উপজীবিকা করিয়া তোলে। মরুপ্রায় দেশে যে আরব বাস করে তাহাকে যদি অন্যদেশবাসীর ইতিহাস শুনাইয়া বলা যায় যে কৃষির সাহায্য ব্যতীত উন্নতিলাভ করা যায় না তবে সে উপদেশ ব্যর্থ হয় এবং কৃষিযোগ্য স্থানের অধিবাসীর নিকট যদি প্রমাণ করিতে বসা যায় যে মৃগয়া এবং পশুপালনেই সাহস ও বীর্যের চর্চা হইতে পারে, কৃষিতে তাহা নষ্টই হয়, তবে সেরূপ নিষ্ফল উত্তেজনা কেবল অনিষ্টই ঘটায়।

বস্তুত, ভিন্ন পথ দিয়া ভিন্ন জাতি ভিন্ন শ্রেণীর উৎকর্ষ লাভ করে এবং সমগ্র মানুষের সর্বাঙ্গীণ উন্নতিলাভের এই একমাত্র উপায়। য়ুরোপ কতকগুলি প্রাকৃতিক সুবিধাবশত যে বিশেষপ্রকারের উন্নতির অধিকারী হইয়াছে আমরা যদি ঠিক সেইপ্রকার উন্নতির জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠি তবে, নিজেকে ব্যর্থ ও বিশ্বমানবকে বঞ্চিত করিব। কারণ, আমাদের দেশের বিশেষ প্রকৃতি অনুসারে আমরা মনুষ্যত্বের যে উৎকর্ষ লাভ করিতে পারি, পরের বৃথা অনুকরণ-চেষ্টায় তাহাকে নষ্ট করিলে এমন একটা জিনিসকে নষ্ট করা হয় যাহা মানুষ অন্য কোনো স্থান হইতে পাইতে পারে না। সুতরাং, বিশ্বমানব সেই অংশে দরিদ্র হয়। চাষের জমিকে খনির মতো ব্যবহার করিলে ও খনিজের জমিকে কৃষিক্ষেত্রের কাজে লাগাইলে মানবসভ্যতাকে ফাঁকি দেওয়া হয়।

যে কারণেই হউক, য়ুরোপের সঙ্গে ভারতবর্ষের কতকগুলি গুরুতর প্রভেদ আছে। উৎকট অনুকরণের দ্বারা সেই প্রভেদকে দূর করিয়া দেওয়া যে কেবল অসম্ভব তাহা নহে, দিলে তাহাতে বিশ্বমানবের ক্ষতি হইবে।

আমরা যখন বিদেশের ইতিহাস পড়ি বা বিদেশের প্রতাপকে প্রত্যক্ষ চক্ষে দেখি তখন নিজেদের প্রতি ধিক্‌কার জন্মে—তখন বিদেশীর সঙ্গে আমাদের যে যে বিষয়ে পার্থক্য দেখিতে পাই সমস্তই আমাদের অনর্থের হেতু বলিয়া মনে হয়। কোনো অধ্যাপকের অর্বাচীন বালকপুত্র যখন সার্কাস দেখিতে যায় তাহার মনে হইতে পারে যে, এমনি করিয়া ঘোড়ার পিঠের উপরে দাঁড়াইয়া লাফালাফি করিতে যদি শিখি এবং দর্শকদলের বাহবা পাই তবেই জীবন সার্থক হয়। তাহার পিতার শান্তিময় কাজ তাহার কাছে অত্যন্ত নির্জীব ও নিরর্থক বলিয়া মনে হয়।

বিশেষ স্থলে পিতাকে ধিক্‌কার দিবার কারণ থাকিতেও পারে। সার্কাসের খেলোয়াড় যেরূপ অক্লান্ত সাধনা ও অধ্যবসায়ের দ্বারা নিজের ব্যবসায়ে উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে, সেইরূপ উদ্যম ও উদ্‌যোগের অভাবে অধ্যাপক যদি নিজের কর্মে উন্নতি লাভ না করিয়া থাকেন তবেই তাঁহাকে লজ্জা দেওয়া চলে।

য়ুরোপের সঙ্গে ভারতের পার্থক্য অনুভব করিয়া যদি আমাদের লজ্জা পাইতে হয় তবে লজ্জার কারণটা ভালো করিয়া বিচার করিতে হয়, নতুবা যথার্থ লজ্জার মূল কখনো উৎপাটিত হইবে না। যদি বলি যে, ইংলাণ্ডের পার্লামেন্ট আছে, ইংলাণ্ডের যৌথ কারবার আছে, ইংলাণ্ডে প্রায় প্রত্যেক লোকই রাষ্ট্রচালনায় কিছুনা-কিছু অধিকারী, এইজন্য তাহারা বড়ো, সেইগুলি নাই বলিয়াই আমরা ছোটো, তবে গোড়ার কথাটা বলা হয় না। আমরা কোনো কৌতুকপ্রিয় দেবতার বরে যদি কয়েক দিনের জন্য মূঢ় আবুহোসেনের মতো ইংরেজি মাহাত্ম্যের বাহ্য অধিকারী হই, আমাদের বন্দরে বাণিজ্যতরীর আবির্ভাব হয়, পার্লামেন্টের গৃহচূড়া আকাশ ভেদ করিয়া উঠে, তবে প্রথম অঙ্কের প্রহসন পঞ্চম অঙ্কে কী মর্মভেদী অশ্রুপাতেই অবসিত হয়! আমরা এ কথা যেন কোনোমতেই না মনে করি যে পার্লামেন্ট মানুষ গড়ে—বস্তুত মানুষই পার্লামেন্ট গড়ে। মাটি সর্বত্রই সমান; সেই মাটি লইয়া কেহ বা