যাত্রার পূর্বপত্র
সামান্য, তাহার দুর্গতির মূর্তিও অতি প্রশান্ত। অশান্তির ক্ষোভ এবং পাপের প্রচণ্ডতা য়ুরোপীয় সমাজে যেমন প্রত্যক্ষ হয়, এমন আমাদের দেশে নহে, এ কথা স্বীকার করিতে হইবে।

কিন্তু তাহাকে তাহারা উদাসীনভাবে মানিয়া লয় নাই। তাহা তাহাদের চিত্তকে অভিভূত করে না, বরঞ্চ নিয়তই জাগ্রত করিয়া রাখিয়াছে। ম্যালেরিয়ার বাহন মশা হইতে আরম্ভ করিয়া সমাজের ভিতরকার পাপ পর্যন্ত সকল অসুখের সঙ্গেই সেখানে হাতাহাতি লড়াই চলিতেছে, অদৃষ্টের উপর বরাত দিয়া কেহ বসিয়া নাই; নিজের প্রাণকেও সংকটাপন্ন করিয়া বীরের দল সংগ্রাম করিতেছে। সম্প্রতি London Police Courts-নামক একটি আশ্চর্য বই পড়িতেছিলাম। সেই গ্রন্থে লণ্ডন-রাজধানীর নীচের অন্ধকার তলায় দারিদ্র্যের মালিন্য ও পাপের পঙ্কিলতা উদ্‌ঘাটিত হইয়া বর্ণিত হইয়াছে। এই চিত্র যতই নিদারুণ হউক, খৃস্টান তাপসের অদ্ভুত ধৈর্য বীর্য ও করুণাপরায়ণ প্রেম সমস্ত বীভৎসতাকে ছাড়াইয়া উঠিয়া উজ্জ্বল দীপ্তিতে প্রকাশ পাইয়াছে। গীতায় একটি আশার বাণী আছে, স্বল্পপরিমাণ ধর্মও মহৎ ভয় হইতে ত্রাণ করে। কোনো সমাজে সেই ধর্মকে যতক্ষণ সজীব দেখা যায় ততক্ষণ সেখানকার ভূরিপরিমাণ দুর্গতির অপেক্ষাও তাহাকে বড়ো করিয়া জানিতে হইবে।

য়ুরোপে দুর্বল জাতির প্রতি ন্যায়ধর্মের ব্যাভিচার দেখা যাইতেছে না এমন নহে, কিন্তু তাহাই একান্ত হইয়া নাই। সেই সঙ্গেই সেই নিষ্ঠুর বলদৃপ্ত লুব্ধতার মধ্য হইতেই ধিক্কার ও ভর্ৎসনা উচ্ছ্বসিত হইতেছে। প্রবলের অন্যায়ের প্রতিবাদ করিতে পারেন এবং প্রতিকার করিতে চাহেন এমন সাহসিক বীরও সেখানে অনেক আছেন। দূরবর্তী পরজাতির পক্ষ অবলম্বন করিয়া নির্যাতন সহ্য করিতে কুণ্ঠিত নহেন, এমন দৃঢ়নিষ্ঠ সাধুব্যক্তির সেখানে অভাব নাই। ভারতবাসীরা স্বদেশের রাজ্যশাসনে প্রশস্ত অধিকার লাভ করেন, সেই চেষ্টায় প্রবৃত্ত গুটিকয়েক ভারতবর্ষীয় আমাদের দেশে আছেন—কিন্তু দীক্ষা তাঁহারা কাহাদের কাছে পাইয়াছেন এবং যথার্থ সহায় তাঁহাদের কে। যাঁহারা আত্মীয়দের বিদ্রূপ ও প্রতিকূলতা স্বীকার করিয়া স্বজাতির স্বার্থপরতার ক্ষেত্রকে সংকীর্ণ করিবার জন্য দেশের লোককে ধর্মের দোহাই দিতেছেন, তাঁহারা কোন্‌ দেশের মানুষ। তাঁহারা সংখ্যায় অল্প, কিন্তু সত্যদৃষ্টিতে দেখিলে দেখা যাইবে,তাঁহারা সংখ্যায় অল্প নহেন। কেননা, তাঁহাদের মধ্যেই তাঁহাদের শেষ নহে। দেশের মধ্যে গোচর এবং অগোচর তাঁহাদের একটি পরম্পরা আছে; তাঁহারা সকলেই এক কাজ করিতেছেন বা এক সময়ে আছেন তাহা নহে, কিন্তু তাঁহারাই সমাজের ভিতরকার ন্যায়শক্তি। তাঁহারাই ক্ষত্রিয়; পৃথিবীর সমস্ত দুর্বলকে ক্ষয় হইতে ত্রাণ করিবার জন্য তাঁহারা সহজ কবচ ধারণ করিয়াছেন। দুঃখ হইতে মানুষকে অমৃতলোকে লইয়া যাইবার জন্য যিনি মৃত্যু স্বীকার করিয়াছেন, সেই তাঁহাদের স্বর্গীয় গুরুর অপমানিত রক্তাক্ত দুর্গম পথে তাঁহারা সারি সারি চলিয়াছেন। সমস্ত জাতির চিত্তপ্রান্তরের মাঝখান দিয়া তাঁহারাই অমৃতমন্দাকিনীর ধারা।

আমরা সর্বদাই নিজেকে এই বলিয়া সান্ত্বনা দিয়া থাকি যে, আমরা ধর্মপ্রাণ আধ্যাত্মিক জাতি, বাহিরের বিষয়ে আমাদের মনোযোগ নাই; এইজন্যই বহির্বিষয়েই আমরা দুর্বল হইয়াছি। বাহিরের দৈণ্য সম্বন্ধে আমাদের লজ্জাকে এমনি করিয়া আমরা খর্ব করিতে চাই। আমাদের অনেকেই মুখে আস্ফালন করিয়া বলিয়া থাকেন, দারিদ্র্যই আমাদের ভূষণ।

ঐশ্বর্যকে অধিকার করিবার শক্তি যাহাদের আছে দারিদ্র্য তাহাদেরই ভূষণ। যে ভূষণের কোনো মূল্য নাই, তাহা ভূষণই নহে। এইজন্য ত্যাগের দারিদ্র্যই ভূষণ, অভাবের দারিদ্র্য ভূষণ নহে; শিবের দারিদ্র্যই ভূষণ, অলক্ষ্মীর দারিদ্র্য কদর্য। যাহারা পেট ভরিয়া খাইতে পায় না বলিয়া নিয়ত অবসাদে মলিন, যাহারা কোনোমতে প্রাণ বাঁচাইতে চায় অথচ প্রাণ বাঁচাইবার কঠিন উপায় গ্রহণ করিবার শক্তি নাই বলিয়া যাহারা বারবার ধুলায় লুটাইয়া পড়ে, দরিদ্র বলিয়াই যাহারা সুযোগ পাইলে অন্য দরিদ্রকে শোষণ করে এবং অক্ষম বলিয়াই ক্ষমতা পাইলে যাহরা অন্য অক্ষমকে আঘাত করে, কখনোই দারিদ্র্য তাহাদের ভূষণ নহে।

আমাদের এই-যে দুঃখ দারিদ্র্য অপমান ইহাকে কোনোমতেই আমাদের ধর্মপ্রাণতার পুরস্কার বলিয়া আমরা আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করিতে পারি নাই; তাহাকে ব্যক্তিগত ভক্তিসাধনার মধ্যে বদ্ধ করিয়াছি, তাহার আহ্বানে সমস্ত মানুষকে একত্র করি