চীনেম্যানের চিঠি
তো তাহাকে অত্যন্ত আশঙ্কার চক্ষে দেখি। তোমরা বলিবে, সে বিশৃঙ্খলা সাময়িক। আমি তো দেখিতেছি, তোমাদের দেশে তাহা চিরস্থায়ী। আচ্ছা, সে কথাও যাক, তাহাতে আমাদের লাভটা কী? আমরা তো তোমাদেরই মতো হইয়া যাইব! সে সম্ভাবনা কি অবিচলিতচিত্তে কল্পনা করা যায়? তোমাদের লোকেরা নাহয় আমাদের চেয়ে আরামে খায় বেশি, পান করে বেশি, নিদ্রা যায় বেশি–কিন্তু তাহারা প্রফুল্ল নয়, সন্তুষ্ট নয়, শ্রমানুরাগী নয়, তাহারা আইন মানে না। তাহাদের কর্ম শরীরমনের পক্ষে অস্বাস্থ্যকর, তাহারা প্রকৃতি হইতে বিচ্যুত হইয়া, ভূমিখণ্ডের অধিকার হইতে বঞ্চিত হইয়া, শহরে এবং কারখানার মধ্যে ঠাসাঠাসি করিয়া থাকে।’

‘আমাদের কবিগণ–লেখকগণ–ধনের মধ্যে, ক্ষমতার মধ্যে, নানাপ্রকার উদ্‌যোগের মধ্যে, কল্যাণ অনুসন্ধান করিতে উপদেশ দেন নাই; কিন্তু মানবজীবনের অত্যন্ত সরল ও বিশ্বব্যাপী সম্বন্ধগুলির সংযত সুনির্বাচিত সুমার্জিত রসাস্বাদনের পথে আমাদের মনকে তাঁহারা প্রবর্তিত করিয়াছেন। এই জিনিসটা আমাদের আছে–এটা তোমরা আমাদিগকে দিতে পার না,কিন্তু এটা তোমরা অনায়াসে অপহরণ করিতে পার। তোমাদের কলের গর্জনের মধ্যে ইহার স্বর শোনা যায় না, তোমাদের কারখানার কালো ধোঁওয়ার মধ্যে ইহাকে দেখিতে পাওয়া যায় না, তোমাদের বিলাতী জীবনযাত্রার ঘূর্ণি এবং ঘর্ষণের মধ্যে ইহা মরিয়া যায়। যে কেজো লোকদিগকে তোমরা অত্যন্ত খাতির করিয়া থাক, যখন দেখি তাহারা ঘণ্টার পর ঘণ্টায়, দিনের পর দিনে, বৎসরের পর বৎসরে, তাহাদের জাঁতার মধ্যে আনন্দহীন অগত্যাপ্রেরিত খাটুনিতে নিযুক্ত–যখন দেখি তাহাদের দিনের উৎকণ্ঠাকে তাহারা স্বল্পাবশিষ্ট অবকাশের মধ্যে টানিয়া আনিতেছে, এবং পরিশ্রমের দ্বারা ততটা নহে যতটা শুষ্ক সংকীর্ণ দুশ্চিন্তা দ্বারা আপনাকে জীর্ণ করিয়া ফেলিতেছে–তখন এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে যে, আমাদের দেশের প্রাচীন বৈশ্যবৃত্তির সরলতর পদ্ধতির কথা স্মরণ করিয়া আমি সন্তোষ লাভ করি, এবং আমাদের যে-সকল চিরব্যবহৃত পথগুলি আমাদের অভ্যস্ত চরণের কাছে এমন পরিচিত যে তাহা দিয়া চলিবার সময়েও অনন্ত নক্ষত্রমণ্ডলীর দিকে দৃষ্টিপাত করিবার জন্য আমাদের অবকাশের অভাব ঘটে না, তোমাদের সমুদয় নূতন ও ভয়সংকুল বর্ত্মের চেয়ে সেই পথগুলিকে আমি অধিক মূল্যবান বলিয়া গৌরব করি।’

ইহার পরে লেখক রাষ্ট্রতন্ত্রের কথা তুলিয়াছেন। তিনি বলেন–

‘গবর্মেণ্ট্‌ তোমাদের কাছে এতই প্রধান এবং সর্বত্রই সে তোমাদের সঙ্গে এমনি লাগিয়াই আছে যে, যে জাতি গবর্মেণ্ট্‌কে প্রায় সম্পূর্ণই বাদ দিয়া চলিতে পারে, তাহার অবস্থা তোমরা কল্পনাই করিতে পার না। অথচ আমাদেরই সেই অবস্থা। আমাদের সভ্যতার সরল এবং অকৃত্রিম ভাব, আমাদের লোকদের শান্তিপ্রিয় প্রকৃতি, এবং সর্বোচ্চে আমাদের সেই পরিবারতন্ত্র যাহা পোলিটিক্যাল সামাজিক ও আর্থিক ব্যাপারে একএকটি ক্ষুদ্র রাজ্যবিশেষ, তাহারা আমাদিগকে গবর্মেণ্ট-শাসন হইতে এতটা দূর মুক্তিদান করিয়াছে যে য়ুরোপের পক্ষে তা বিশ্বাস করাই কঠিন।’

‘আমাদের সমাজের গোড়াকার জিনিসগুলি কোনো রাজক্ষমতার স্বেচ্ছাকৃত সৃজন নহে। আমাদের জনসাধারণ নিজের জীবনকে এইরূপ শরীরতন্ত্রের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। কোনো গবর্মেণ্ট্‌ তাহাকে গড়ে নাই, কোনো গবর্মেণ্ট তাহার বদল করিতে পারে না। এক কথায় আইন জিনিসটা উপর হইতে আমাদের মাথায় চাপানো হয় নাই–তাহা আমাদের জাতিগত জীবনের মূলসূত্র, এবং যাহা শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ আছে তাহাই ব্যবহারে প্রবর্তিত হইয়াছে। এইজন্য চীনে গবর্মেণ্ট যথেচ্ছাচারী নহে, অত্যাবশ্যকও নয়। রাজপুরুষদের শাসন তুলিয়া লও, তবু আমাদের জীবনযাত্রা প্রায় পূর্বের মতোই চলিয়া যাইবে। যে আইন আমরা মান্য করি সে আমাদের স্বভাবের আইন, বহু শতাব্দীর অভিজ্ঞতায় তাহা অভিব্যক্ত হইয়া উঠিয়াছে–বাহিরের শাসন তুলিয়া লইলেও ইহার কাছে আমরা বশ্যতা স্বীকার করি। যাহাই ঘটুক না, আমাদের পরিবার থাকে, পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে মনের সেই গঠনটি থাকে,সেই শৃঙ্খলা কর্মনিষ্ঠতা ও মিতব্যয়িতার ভাবটি থাকিয়া যায়। ইহারাই চীনকে তৈরি করিয়াছে।’

‘তোমাদের পশ্চিমদেশে গবর্মেণ্ট্‌ ব্যাপারটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এখানে কোনো মূলবিধান নাই, কিন্তু ইচ্ছাকৃত অন্তহীন আইন