বাংলাভাষা-পরিচয় ১২

উকারের ব্যবহার দেখলে মনে পড়ে কোকিলকে, সে যেখানে সেখানে পরের বাসায় ডিম পেড়ে যায়।

এও দেখা গেছে ইআ প্রত্যয়-ওয়ালা শব্দে ইঞ্চকে ঠেলে উ অনধিকারে নিজে আসন জুড়ে বসে, যেমন : জঙ্গল = জঙ্গলিয়া = জঙ্গুলে, বাদল = বাদলিয়া = বাদুলে। এমনিতরো : নাটুকে মাতুনে।

হাতুড়ে কাঠুরে সাপুড়ে হাটুরে ঘেসুড়ে : এদের মধ্যে কোনো-একটা প্রত্যয় যোগে র বা ড় এসে জুটেছে। লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে, ‘ঘেসুড়ে’র ঘাসে লাগল একার, ‘সাপুড়ে’র সাপ রইল নির্বিকার। ভাষাকে প্রশ্ন করলে এক-এক সময়ে ভালো জবাব পাই, এক-এক সময় পাইও নে। চাষ যে করে সে ‘চাষুড়ে’ হল না কেন।

আমার হিন্দিভাষী বন্ধু বলেন, বাংলায় ‘সাপুড়ে’। হিন্দিতে : সঁপেরা = সাঁপ + হারা। বাংলা ‘কাঠুরে’ হিন্দিতে ‘লকড়হারা’, হিন্দিতে ‘কাঠহারা’ কথা নেই। হিন্দির এই ‘হারা’ তদ্ধিত প্রত্যয়; অধিকার অর্থে এর প্রয়োগ, ক্রিয়া অর্থে নয়। বোধ করি সেই কারণে ‘চাষুড়ে’ শব্দটা সম্ভব হয় নি।

স্বরবিকারের আর-একটা অদ্ভুত দৃষ্টান্ত দেখো। ইআ প্রত্যয়-যোগে একটা ওকার খামখা হয়ে গেল উ : গোবোর + ইয়া = গুব্‌রে, কোঁদোল + ইয়া = কুঁদুলে। ‘কুঁদ্‌লে’ হল না কেন সেও একটা প্রশ্ন। ‘গোবোর’ থেকে ওকারটাকে হসন্তের ঘায়ে তাড়িয়ে দিলে, ‘কোঁদোল’ শব্দে ও হসন্তকে জায়গা না দিয়ে নিজে বসল জমিয়ে।

অকারের প্রতি উপেক্ষা সম্বন্ধে আরও প্রমাণ দেওয়া যায়। হাত বুলিয়ে সন্ধান করাকে বলে ‘হাৎড়ানো’, অসমাপিকার ‘হাৎড়িয়ে’। এখানে ‘হাত’এর ত থেকে ছেঁটে দেওয়া হল অকার। অথচ ‘হাতুড়ে’ শব্দের বেলায় নাহক একটা উকার এনে জুড়ে দিলে, তবু অকারকে কিছুতে আমল দিল না। ‘বাদল’ শব্দের উত্তর ইআ প্রত্যয় যোগ করে ‘বাদ্‌লে’ করলে না বটে, কিন্তু দিলে ‘বাদুলে’ করে।

এই-সব দৃষ্টান্ত থেকে বুঝতে পারি, অন্তত পশ্চিম ও দক্ষিণ বঙ্গের রসনার টান আছে উকারের দিকে। ‘হাতড়ি’ শব্দ তাই সহজেই হয়েছে ‘হাতুড়ি’। তা ছাড়া দেখো : বাছুর তেঁতুল বামুন মিশুক হিংসুক বিষ্যুৎবার।১

এই প্রসঙ্গে আর-একটা দৃষ্টান্ত দেবার আছে। ‘চিবোতে’ ‘ঘুমোতে’ শব্দের স্থলে আজকাল ‘চিবুতে’ ‘ঘুমুতে’ উচ্চারণ ও বানান চলেছে। আজকাল বলছি এইজন্যে যে, আমার নিজের কাছে এই উচ্চারণ ছিল অপরিচিত ও অব্যবহৃত। ‘চিবোতে’ ‘ঘুমোতে’ শব্দের মূলরূপ : চিবাইতে ঘুমাইতে। আ += ইঞ্চকে ঠেলে ফেলে নিঃসম্পর্কীয় উ এসে বসল। অবশ্য এর অন্য নজির আছে। বিনানি = বিনুনি, ঝিমানি = ঝিমুনি, পিটানি = পিটুনি শব্দে দেখা যাচ্ছে প্রথম বর্ণের ইকার তার সবর্ণ তৃতীয় বর্ণের’পরে হস্তক্ষেপ করলে না, অথচ মধ্যবর্ণের আঞ্চকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় বসিয়ে দিলে উ। মনে রাখতে হবে, প্রথম বর্ণের ইকার তার এই বন্ধু উ’কে নিমন্ত্রণের জন্যে দায়ী। গোড়ায় যেখানে ইকারের ইঙ্গিত নেই সেখানে উ পথ পায় না ঢুকতে। পূর্বেই তার দৃষ্টান্ত দিয়েছি। ‘ঠ্যাঙানি’ হয় না ‘ঠেঙুনি’, ‘ঠকানি’ হয় না ‘ঠকুনি’, ‘বাঁকানি’ হয় না ‘বাঁকুনি’। ‘চিবুতে’ ‘ঘুমুতে’ উচ্চারণ আমার কানে ঠিক বলে ঠেকে না, সে যে নিতান্ত কেবল অভ্যাসের জন্যে তা আমি মানতে পারি নে। বাংলা ভাষায় এ উচ্চারণ অনিবার্য নয়। আমার বিশ্বাস ‘চিনাইতে’ শব্দকে কেউ ‘চিনুতে’ বলে না, অন্তত আমার তাই ধারণা। ‘দুলাইতে’ কেউ কি ‘দুলুতে’, কিংবা ‘ছুটাইতে’ ‘ছুটুতে’ বলে? ‘বুঝাইতে’ বলতে ‘বুঝুতে’ কেউ বলে কিনা নিশ্চিত জানি নে, আশা করি বলে না। ‘পুরাইতে’ বলতে ‘পুরুতে’ কিংবা ‘ঠকাইতে’ বলতে ‘ঠকুতে’ শুনি নি। আমার নিশ্চিত বোধ হয় ‘কান জুড়ুল’ কেউ বলে না, অথচ ‘ঘুমাইল’ ও ‘জুড়াইল’ একই ছাঁদের কথা।

১ হিন্দীতে ‘হাতুড়ি’ শব্দের প্রতিশব্দ স্ত্রীলিঙ্গে “হতৌড়ি”। বিহারীতে স্ত্রীলিঙ্গে ‘হতউড়ি’। ঔড়া এবং উরা প্রত্যয় থেকে উকারের প্রবেশ স্বাভাবিক। হিন্দুতেও হ্রস্ব ওকারকে উকারের মতো বলবার ও লেখবার প্রবৃত্তি আছে; বোলবানা=বুলবানা,