বাংলাভাষা-পরিচয় ১২
দীর্ঘতা প্রমাণ হয় ‘জলা’ শব্দের জ’এর সঙ্গে তুলনা করে দেখলে। ‘হাত’ আর ‘হাতা’য় প্রথমটির হা দীর্ঘ, দ্বিতীয়টির হ্রস্ব। ‘পিঠ’ আর ‘পিঠে’, ‘ভুত’ আর ‘ভুতো’, ‘ঘোল’ আর ‘ঘোলা’— তুলনা করে দেখলে কথাটা স্পষ্ট হবে। সংস্কৃতে দীর্ঘস্বরের দীর্ঘতা সর্বত্রই, বাংলায় স্থানবিশেষে। কথায় ঝোঁক দেবার সময় বাংলা স্বরের উচ্চারণ সব জায়গাতেই দীর্ঘ হয়, যেমন : ভা—রি তো পণ্ডিত, কে—বা কার খোঁজ রাখে, আ—জই যাব, হল—ই বা, অবা—ক করলে, হাজা—রো লোক, কী— যে বকো, এক ধা—র থেকে লাগা—ও মার। যুক্তবর্ণের পূর্বে সংস্কৃতে স্বর দীর্ঘ হয়। বাংলায় তা হয় না।

বাংলায় একটা অতিরিক্ত স্বরবর্ণ আছে যা সংস্কৃত ভাষায় নেই। বর্ণমালায় সে ঢুকেছে একারের নামের ছাড়পত্র নিয়ে, তার জন্যে স্বতন্ত্র আসন পাতা হয় নি। ইংরেজি bad শব্দের a তার সমজাতীয়। বাংলায় তার বিশেষ বানান করবার সময় আমরা য ফলার আকার দিয়ে থাকি। বাংলায় আমরা যেটাকে বলি অন্ত্যস্থ য, চ বর্গের জ’এর সঙ্গে তার উচ্চারণের ভেদ নেই। য’এর নীচে ফোঁটা দিয়ে আমরা আর-একটা অক্ষর বানিয়েছি তাকে বলি ইয়। সেটাই সংস্কৃত অন্ত্যস্থ য। সংস্কৃত উচ্চারণ-মতে ‘যম’ শব্দ ‘য়ম’। কিন্তু ওটাতে ‘জম’ উচ্চারণের অজুহাতে য়’র ফোঁটা দিয়েছি সরিয়ে। ‘নিয়ম’ শব্দের বেলায় য়’র ফোঁটা রক্ষে করেছি, তার উচ্চারণেও সংস্কৃত বজায় আছে। কিন্তু যফলা-আকারে (‌্যা) য়’কে দিয়েছি খেদিয়ে আর আ’টাকে দিয়েছি বাঁকা করে। সংস্কৃতে ‘ন্যাস’ শব্দের উচ্চারণ ‘নিয়াস’, বাংলায় হল nas। তার পর থেকে দরকার পড়লে য ফলার চিহ্নটাকে ব্যবহার করি আকারটাকে বাঁকিয়ে দেবার জন্যে। Paris শব্দকে বাংলায় লিখি ‘প্যারিস’, সংস্কৃত বানানের নিয়ম অনুসারে এর উচ্চারণ হওয়া উচিত ছিল ‘পিয়ারিস’। একদা ‘ন্যায়’ শব্দটাকে বাংলায় ‘নেয়ায়’ লেখা হয়েছে দেখেছি।

অথচ ‘ন্যায়’ শব্দকে বানানের ছলনায় আমরা তৎসম শব্দ বলে চালাই। ‘যম’কেও আমরা ভয়ে ভয়ে বলে থাকি বিশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দ, অথচ রসনায় ওটা হয়ে দাঁড়ায় তদ্ভব বাংলা।

সংস্কৃত শব্দের একার বাংলায় অনেক স্থলেই স্বভাব পরিবর্তন করেছে, যেমন ‘খেলা’, যেমন ‘এক’। জেলাভেদে এই একারের উচ্চারণ একেবারে বিপরীত হয়। তেল মেঘ পেট লেজ— শব্দে তার প্রমাণ আছে।

পূর্বেই দেখিয়েছি আ এবং অ স্বরবর্ণ সম্বন্ধে ইকার এবং উকারের ব্যবহার আধুনিক খবরের কাগজের ভাষায় যাকে বলে চাঞ্চল্যজনক, অর্থাৎ এরা সর্বদা অপঘাত ঘটিয়ে থাকে। কিন্তু এদের অনুগত একারের প্রতি এরা সদয়। ‘এক’ কিংবা ‘একটা’ শব্দের এ গেছে বেঁকে, কিন্তু উ তাকে রক্ষা করেছে ‘একুশ’ শব্দে। রক্ষা করবার শক্তি আকারের নেই, তার প্রমাণ ‘এগারো’ শব্দে। আমরা দেখিয়েছি ন’এর পূর্বে অ হয়ে যায় ও, যেমন ‘ধন’ ‘মন’ শব্দে। ঐ ন একারের বিকৃতি ঘটায় : ফেন সেন কেন যেন। ইকারের পক্ষপাত আছে একারের প্রতি, তার প্রমাণ দিতে পারি। ‘লিখন’ থেকে হয়েছে ‘লেখা’— বিশুদ্ধ এ— ‘গিলন’ থেকে ‘গেলা’। অথচ ‘দেখন ‘থেকে ‘দ্যাখা,’ ‘বেচন’ থেকে ‘ব্যাচা’, ‘হেলন’ থেকে ‘হ্যালা’। অসমাপিকা ক্রিয়ার মধ্যে এদের বিশেষ রূপগ্রহণের মূল পাওয়া যায়, যেমন : লিখিয়া = লেখা (পূর্ববঙ্গে ‘ল্যাখা’), গিলিয়া = গেলা। কিন্তু : খেলিয়া = খ্যালা, বেচিয়া = ব্যাচা। মিলন অর্থে আর-একটা শব্দ আছে ‘মেলন’, তার থেকে হয়েছে ‘ম্যালা’, আর ‘মিলন’ থেকে হয়েছে ‘মেলা’ (মিলিত হওয়া)।

য ফলার আকার না থাকলেও বাংলায় তার উচ্চারণ অ্যাকার, যেমন ‘ব্যয়’ শব্দে। এটা হল আদ্যক্ষরে। অন্যত্র ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব ঘটায়, যেমন ‘সভ্য’। পূর্বে বলেছি ইকারের প্রতি একারের টান। ‘ব্যক্তি’ শব্দের ইকার প্রথম বর্ণে দেয় একার বসিয়ে, ‘ব্যক্তি’ শব্দ হয়ে যায় ‘বেক্তি’। হ’এর সঙ্গে য ফলা যুক্ত হলে কোথা থেকে জ’এ-ঝ’এ জটলা করে হয়ে দাঁড়ায় ‘সোজ্‌ঝো’। অথচ ‘সহ্য’ শব্দটাকে বাঙালি তৎসম বলতে কুণ্ঠিত হয় না। বানানের ছদ্মবেশ ঘুচিয়ে দিলেই দেখা যাবে, বাংলায় তৎসম শব্দ নেই বললেই হয়। এমন-কি কোনো নতুন সংস্কৃত শব্দ আমদানি করলে বাংলার নিয়মে তখনি প্রাকৃত রূপ ধরবে। ফলে হয়েছে, আমরা লিখি এক আর