বাংলাভাষা-পরিচয় ১৩
মেয়েদের নামের সঙ্গে এক মালায় গাঁথা পড়ে। ‘নিভা’ নামক একটা ছিন্নমুণ্ড শব্দ ‘শরচ্চন্দ্রনিভাননা’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যুক্ত হয়েছে বাঙালি মেয়েদের নামমালায় আকারের টিকিট দেখিয়ে।

স্ত্রীলিঙ্গের কোনো একটি বা একাধিক প্রত্যয় যদি নির্বিশেষে বা বাঁধা নিয়মে ভাষায় খাটত তা হলে একটা শৃঙ্খলা থাকত, কিন্তু সে সুযোগ ঘটে নি। বাংলায় ‘উট’ হয়েতো ‘উটী’, কিন্তু ‘মোষ’ হয় না ‘মোষী’, এমন-কি ‘মোষীনী’ও না—কী হয় বলতে পারি নে, বোধ করি ‘মাদী মোষ’। ‘হাতি’ সম্বন্ধেও ঐ এক কথা, ‘নাতনী’ বলি কিন্তু ‘হাতিনী’ বলি নে। উট-হাতির চেয়ে কুকুর-বিড়াল পরিচিত জীব, ‘কুকুরী’ ‘বিড়ালী’ বললেই চলত, কিংবা ‘কুকুরনী’ ‘বিড়ালনী’। বলা হয় না। মানুষ সম্বন্ধেও কেমন একটা ইতস্তত আছে— ‘খোট্টানি’ ‘উড়েনি’ বলে থাকি, কিন্তু ‘পাঞ্জাবিনী’ ‘শিখিনী’ ‘মগিনী’ বলি নে; ‘মাদ্রাজিনী’ও তদ্রূপ; ‘বাঙালিনী’ বলি নে, ‘কাঙালিনী’ বলে থাকি।

আত্মীয়তা সম্বন্ধেও নামগুলিতে স্ত্রী প্রত্যয়ের ছাপ আছে : দিদি মাসি পিসি শ্যালী শাশুড়ি ভাইঝি বোনঝি। ‘ননদ’ শব্দে ইনী যোগ না করলেও তার প্রভাব সম্পূর্ণ থেকে যায়। জা শ্যালাজ প্রভৃতি শব্দে দীর্ঘ ঈকারের সমাগম নেই।

জাতঘটিত ব্যাবসাঘটিত নামে নী ইনী যথেষ্ট চলে : বাম্‌নী কায়েতনী। অন্য জাত সম্বন্ধে সন্দেহ আছে। ‘বদ্দিনী’ কখনো শুনি নি। ‘বাগদিনী’ চলে, ‘ডোমনী’ ‘হাড়িনী’ও শুনেছি, ‘সাঁওতালনী’ বললে খটকা লাগে না। পুরুতনী ধোবানী নাপতিনী কামারনী কুমোরনী তাঁতিনী : সর্বদাই ব্যবহার হয়। অথচ শেলাই ব্যাবসা ধরলেও মেয়েরা ‘দর্জিনী’ উপাধি পাবে কি না সন্দেহ। যা হোক মোটের উপর বাংলায় স্ত্রীলিঙ্গে নী ইনী প্রত্যয়টারই চল বেশি।

একটা বিষয়ে বাংলাকে বাহাদুরি দিতে হবে। য়ুরোপীয় অনেক ভাষায়, তা ছাড়া হিন্দি হিন্দুস্থানি গুজরাটি মারাঠিতে, কাল্পনিক খেয়ালে বা স্বরবর্ণের বিশেষত্ব নিয়ে লিঙ্গভেদপ্রথা চলেছে। ভাষার এই অসংগত ব্যবহার বিদেশীদের পক্ষে বিষম সংকটের। বাংলা এ সম্বন্ধে বাস্তবকে মানে। বাংলায় কোনোদিন ঘুড়ি উড্ডীয়মানা হবে না, কিংবা বিজ্ঞাপনে নির্মলা চিনির পাকে সুমধুরা রসগোল্লার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করবে না। কিংবা শুশ্রূষার কাজে দারুণা মাথাধরায় বরফশীতলা জলপটির প্রয়োগ-সম্ভাবনা নেই।

এইখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি। সংস্কৃত ভাষার নিয়মে বাংলার স্ত্রীলিঙ্গ প্রত্যয়ে এবং অন্যত্র দীর্ঘ ঈকার বা ন’এ দীর্ঘ ঈকার মানবার যোগ্য নয়। খাঁটি বাংলাকে বাংলা বলেই স্বীকার করতে যেন লজ্জা না করি, প্রাচীন প্রাকৃত ভাষা যেমন আপন সত্য পরিচয় দিতে লজ্জা করে নি। অভ্যাসের দোষে সম্পূর্ণ পারব না, কিন্তু লিঙ্গভেদসূচক প্রত্যয়ে সংস্কৃত ব্যাকরণ কতকটা স্বীকার করার দ্বারা তার ব্যাভিচারটাকেই পদে পদে ঘোষণা করা হয়। তার চেয়ে ব্যাকরণের এই-সকল স্বেচ্ছাচার বাংলা ভাষারই প্রকৃতিগত এই কথাটা স্বীকার করে নিয়ে যেখানে পারি সেখানে খাঁটি বাংলা উচ্চারণের একমাত্র হ্রস্ব ইকারকে মানব। ‘ইংরেজি’ বা ‘মুসলমানি’ শব্দে যে ই-প্রত্যয় আছে সেটা যে সংস্কৃত নয়, তা জানাবার জন্যই অসংকোচ হ্রস্ব ইকার ব্যবহার করা উচিত। ওটাকে ইন্‌-ভাগান্ত গণ্য করলে কোন্‌ দিন কোনো পণ্ডিতাভিমানী লেখক ‘মুসলমানিনী’ কায়দা বা ‘ইংরেজিনী’ রাষ্ট্রনীতি বলতে গৌরব বোধ করবেন এমন আশঙ্কা থেকে যায়।