সীতারামের কাছে এইরূপ সাহায্যপ্রাপ্তির আশা পাইয়া ভাগবত বন্ধুতার উচ্ছ্বাসে যে নিতান্ত উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছিল, তাহা নহে। আর-এক ছিলিম তামাক সাজিয়া চুপ করিয়া বসিয়া টানিতে লাগিল।
সীতারাম আস্তে আস্তে কথা পাড়িল, “দাদা, রাজার অন্যায় বিচারে আমাদের তো অন্ন মারা গেল।” ভাগবত কহিল, “কই তোমার ভাবে তো তাহা বোধ হইল না!” সীতারামের বদান্যতা ভাগবতের বড়ো সহ্য হয় নাই, মনে মনে কিছু চটিয়াছিল।
সীতারাম কহিল, “না ভাই, কথার কথা বলিতেছি! আজ না যায় তো দশ দিন পরে তো যাইবে।”?
ভাগবত কহিল, “তা রাজা যদি অন্যায় বিচার করেন তো আমরা কী করিতে পারি।”
সীতারাম করিল, “আহা যুবরাজ যখন রাজা হইবে, তখন যশোরে রামরাজত্ব হইবে, ততদিন যেন আমরা বাঁচিয়া থাকি।”
ভাগবত চটিয়া গিয়া কহিল, “ও-সব কথায় আমাদের কাজ কী ভাই? তুমি বড়োমানুষ লোক, তুমি নিজের ঘরে বসিয়া রাজা-উজির মার, সে শোভা পায়। আমি গরিব মানুষ, আমার অতটা ভরসা হয় না।”
সীতারাম কহিল, “রাগ কর কেন দাদা? কথাটা মন দিয়া শোনোই না কেন?” বলিয়া চুপি চুপি কী বলিতে লাগিল।
ভাগবত মহাক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, “দেখো সীতারাম, আমি তোমাকে স্পষ্ট করিয়া বলিতেছি, আমার কাছে অমন কথা তুমি মুখে উচ্চারণ করিয়ো না।”
সীতারাম সেদিন তো চলিয়া গেল। ভাগবত ভারি মনোযোগ দিয়া সমস্ত দিন কী একটা ভাবিতে লাগিল, তাহার পরদিন সকালবেলায় সে নিজে সীতারামের কাছে গেল। সীতারামকে কহিল, “কাল যে কথাটা বলিয়াছিলে বড়ো পাকা কথা বলিয়াছিলে।”
সীতারাম গর্বিত হইয়া উঠিয়া কহিল, “কেমন দাদা, বলি নাই!”
ভাগবত কহিল, “আজ সেই বিষয়ে তোমার সঙ্গে পরামর্শ করিতে আসিয়াছি।”
সীতারাম আরো গর্বিত হইয়া উঠিল। কয়দিন ধরিয়া ক্রমিক পরামর্শ চলিতে লাগিল।
পরামর্শ করিয়া যাহা স্থির হইল তাহা এই, একটা জাল দরখাস্ত লিখিতে হইবে, যেন যুবরাজ প্রতাপাদিত্যের নামে সম্রাট-বিদ্রোহিতার অভিযোগ করিয়া নিজে রাজ্য পাইবার জন্য দরখাস্ত করিতেছেন। তাহাতে যুবরাজের সীলমোহর মুদ্রিত থাকিবে। রুক্মিণী যে আংটিটি লইয়া আসিয়াছে, তাহাতে যুবরাজের নাম-মুদ্রাঙ্কিত সীল আছে, অতএব কাজ অনেকটা অগ্রসর হইয়া আছে।
পরামর্শমতো কাজ হইল। একখানা জাল দরখাস্ত লেখা হইল, তাহাতে যুবরাজের নাম মুদ্রিত রহিল। নির্বোধ সীতারামের উপর নির্ভর করা যায় না, অতএব স্থির হইল, ভাগবত নিজে দরখাস্ত লইয়া দিল্লীশ্বরের হস্তে সমর্পণ করিবে।
ভাগবত সেই দরখাস্তখানি লইয়া দিল্লির দিকে না গিয়া প্রতাপাদিত্যের কাছে গেল। মহারাজকে কহিল, “উদয়াদিত্যের এক ভৃত্য এই দরখাস্তটি লইয়া দিল্লির দিকে যাইতেছিল, আমি কোনো সূত্রে জানিতে পারি। ভৃত্যটা দেশ ছাড়িয়া পলাইয়া গেছে, দরখাস্তটি লইয়া আমি মহারাজের নিকট আসিতেছি।” ভাগবত সীতারামের নাম করে নাই। দরখাস্ত পাঠ করিয়া প্রতাপাদিত্যের কী অবস্থা হইল তাহা আর বলিবার আবশ্যক করে না। ভাগবতের পুনর্বার রাজবাড়িতে চাকরি হইল।