খাঁ সাহেব গান ধরিলেন–
তাজবে তাজ নওবে নও।
দেখিতে দেখিতে বসন্ত রায় মাতিয়া উঠিলেন আর বসিয়া থাকিতে পারিলেন না। উঠিয়া দাঁড়াইলেন, একত্রে গাহিতে লাগিলেন– তাজবে তাজ নওবে নও। ঘন ঘন তাল দিতে লাগিলেন এবং বারবার করিয়া গাহিতে লাগিলেন। গাহিতে গাহিতে সূর্য অস্ত গেল, অন্ধকার হইয়া আসিল, রাখালেরা বাড়িমুখে আসিতে আসিতে গান ধরিল। এমন সময়ে আসিয়া সীতারাম “মহারাজের জয় হউক” বলিয়া প্রণাম করিল। বসন্ত রায় একেবারে চমকিত হইয়া তৎক্ষণাৎ গান বন্ধ করিয়া তাড়াতাড়ি তাহার কাছে আসিয়া তাহার গায়ে হাত দিয়া কহিলেন, “আরে সীতারাম যে! ভালো আছিস তো? দাদা কেমন আছে? দিদি কোথায়? খবর ভালো তো?”
খাঁ সাহেব চলিয়া গেল। সীতারাম কহিল, “একে একে নিবেদন করিতেছি মহারাজ।” বলিয়া একে একে যুবরাজের কারারোধের কথা কহিল। সীতারাম আগাগোড়া সত্য কথা বলে নাই। যে-কারণে উদয়াদিত্যের কারারোধ ঘটিয়াছিল, সে-কারণটা তেমন স্পষ্ট করিয়া বলে নাই।
বসন্ত রায়ের মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িল, তিনি সীতারামের হাত দৃঢ় করিয়া ধরিলেন। তাঁহার ভ্রূ ঊর্ধ্বে উঠিল, তাঁহার চক্ষু প্রসারিত হইয়া গেল, তাঁহার অধরৌষ্ঠ বিভিন্ন হইয়া গেল– নির্নিমেষ নেত্রে সীতারামের মুখের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “অ্যাঁ?”
সীতারাম কহিল, “আজ্ঞা, হাঁ মহারাজ।”
কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া বসন্ত রায় কহিলেন, “সীতারাম!”
সীতারাম। মহারাজ।
বসন্ত রায়। তাহা হইলে দাদা এখন কোথায়?
সীতারাম। আজ্ঞা, তিনি কারাগারে।
বসন্ত রায় মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন। উদয়াদিত্য কারাগারে, এ কথাটা বুঝি তাঁহার মাথায় ভালো করিয়া বসিতেছে না, কিছুতেই কল্পনা করিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। আবার কিছুক্ষণ বাদে সীতারামের হাত ধরিয়া কহিলেন, “সীতারাম!”
সীতারাম। আজ্ঞা মহারাজ।
বসন্ত রায়। তাহা হইলে দাদা এখন কী করিতেছে?
সীতারাম। কী আর করিবেন। তিনি কারাগারেই আছেন।
বসন্ত রায়। তাহাকে কি সকলে বন্ধ করিয়া রাখিয়াছে?
সীতারাম। আজ্ঞা হাঁ মহারাজ।
বসন্ত রায়। তাহাকে কি কেহ একবার বাহির হইতে দেয় না?
সীতারাম। আজ্ঞা না।
বসন্ত রায়। সে একলা কারাগারে বসিয়া আছে?
বসন্ত রায় এ কথাগুলি বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করেন নাই– আপনা-আপনি বলিতেছিলেন।
সীতারাম তাহা বুঝিতে পারে নাই– সে উত্তর করিল, “হাঁ মহারাজ।”
বসন্ত রায় বলিয়া উঠিলেন, “দাদা, তুই আমার কাছে আয় রে, তোকে কেহ চিনিল না।”