মুক্তিয়ার খাঁ বিনীতভাবে কহিল, “জনাব, আমাদের মহারাজের নিকট হইতে আদেশ লইয়া আসিতেছি।”
যুবরাজ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী আদেশ।”
মুক্তিয়ার খাঁ প্রতাপাদিত্যের স্বাক্ষরিত আদেশপত্র বাহির করিয়া যুবরাজের হাতে দিল। যুবরাজ পড়িয়া কহিলেন, “ইহার জন্য এত সৈন্যের প্রয়োজন কী? আমাকে একখানা পত্র লিখিয়া আদেশ করিলেই তো আমি যাইতাম। আমি তো আপনিই যাইতেছিলাম, যাইব বলিয়াই স্থির করিয়াছি। তবে আর বিলম্বে প্রয়োজন কী? এখনই চলো। এখনই যশোহরে ফিরিয়া যাই।” মুক্তিয়ার খাঁ হাত জোড় করিয়া কহিল, “এখনই ফিরিতে পারিব না।” যুবরাজ ভীত হইয়া কহিলেন, “কেন?”
মুক্তিয়ার খাঁ কহিল, “আর-একটি আদেশ আছে, তাহা পালন না করিয়া যাইতে পারিব না।”
যুবরাজ ভীতস্বরে কহিলেন, “কী আদেশ!”
মুক্তিয়ার খাঁ কহিল, “রায়গড়ের রাজার প্রতি মহারাজা প্রাণদণ্ডের আদেশ করিয়াছেন।”
যুবরাজ চমকিয়া উচ্চস্বরে কহিয়া উঠিলেন, “না, করেন নাই, মিথ্যা কথা।”
মুক্তিয়ার খাঁ কহিল, “আজ্ঞা যুবরাজ, মিথ্যা নহে। আমার নিকট মহারাজের স্বাক্ষরিত পত্র আছে।”
যুবরাজ সেনাপতির হাত ধরিয়া ব্যগ্র হইয়া কহিলেন, “মুক্তিয়ার খাঁ, তুমি ভুল বুঝিয়াছ। মহারাজ আদেশ দিয়াছেন যে, যদি উদয়াদিত্যকে না পাও, তাহা হইলে বসন্ত রায়ের--আমি যখন আপনি ধরা দিতেছি তখন আর কী! আমাকে এখনই লইয়া চলো, এখনই লইয়া চলো--আমাকে বন্দী করিয়া লইয়া চলো, আর বিলম্ব করিয়ো না।”
মুক্তিয়ার খাঁ কহিল, “যুবরাজ, আমি ভুল বুঝি নাই। মহারাজ স্পষ্ট আদেশ করিয়াছেন।”
যুবরাজ অধীর হইয়া কহিলেন, “তুমি নিশ্চয়ই ভুল বুঝিয়াছ! তাঁহার অভিপ্রায় এরূপ নহে। আচ্ছা চলো, যশোহরে চলো। আমি মহারাজের সম্মুখে তোমাদের বুঝাইয়া দিব, তিনি যদি দ্বিতীয় বার আদেশ করেন, তবে আদেশ সম্পন্ন করিয়ো।”
মুক্তিয়ার জোড়হস্তে কহিল, “যুবরাজ, মার্জনা করুন তাহা পারিব না।”
যুবরাজ অধিকতর অধীর হইয়া কহিলেন, “মুক্তিয়ার, মনে আছে, আমি এক কালে সিংহাসন পাইব? আমার কথা রাখো, আমাকে সন্তুষ্ট করো।”
মুক্তিয়ার নিরুত্তরে দাঁড়াইয়া রহিল।
যুবরাজের মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গেল, তাঁহার কপালে ঘর্মবিন্দু দেখা দিল। তিনি সেনাপতির হাত দৃঢ়ভাবে ধরিয়া কহিলেন, “মুক্তিয়ার খাঁ, বৃদ্ধ নিরাপরাধ পুণ্যাত্মাকে বধ করিলে নরকেও তোমার স্থান হইবে না।”
মুক্তিয়ার খাঁ কহিল, “মনিবের আদেশ পালন করিতে পাপ নাই।”
উদয়াদিত্য উচ্চৈঃস্বরে কহিয়া উঠিলেন, “মিথ্যা কথা। যে ধর্মশাস্ত্রে তাহা বলে, সে ধর্মশাস্ত্র মিথ্যা। নিশ্চয়ই জানিয়ো মুক্তিয়ার, পাপ আদেশ পালন করিলে পাপ।”
মুক্তিয়ার নিরুত্তরে দাঁড়াইয়া রহিল।
উদয়াদিত্য চারিদিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, “তবে আমাকে ছাড়িয়া দাও। আমি গড়ে ফিরিয়া যাই। তোমার
সৈন্যসামন্ত লইয়া সেখানে যাও, আমি তোমাকে যুদ্ধে আহ্বান করিতেছি। সেখানে রণক্ষেত্রে জয়লাভ করিয়া তার পরে তোমার আদেশ পালন করিয়ো।”
মুক্তিয়ার নিরুত্তরে দাঁড়াইয়া রহিল। সৈন্যগণ অধিকতর ঘেঁষিয়া আসিয়া যুবরাজকে ঘিরিল। যুবরাজ কোনো উপায় না দেখিয়া সেই অন্ধকারে প্রাণপণে চীৎকার করিয়া উঠিলেন, “দাদামহাশয়, সাবধান।” বন কাঁপিয়া উঠিল, মাঠের প্রান্তে গিয়া সে সুর মিলাইয়া গেল। সৈন্যেরা আসিয়া উদয়াদিত্যকে ধরিল। উদয়াদিত্য আর-একবার চীৎকার করিয়া উঠিলেন, “দাদামহাশয়, সাবধান।” এক জন