পূর্বে এক স্থানে বলিয়াছি, যে, যখন জগতের স্বপক্ষে থাকি তখনই আমাদের প্রকৃত সুখ, যখন স্বার্থ খুঁজিয়া মরি তখনই আমাদের ক্লেশ, শ্রান্তি, অসন্তোষ। ইহা হইতে আর-একটা কথা মনে আসে। যাহাদিগকে আমরা সুন্দর বলি তাহাদিগকে আমাদের কেন ভাল লাগে?
পণ্ডিতেরা বলেন, যে সুন্দর তাহার মধ্যে বিষম কিছুই নাই; তাহার আপনার মধ্যে আপনার পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য; তাহার কোন-একটি অংশ অপর-একটি অংশের সহিত বিবাদ করে না; জেদ করিয়া অন্য সকলকে ছাড়াইয়া উঠে না; ঈর্ষাবশত স্বতন্ত্র হইয়া মুখ বাঁকাইয়া থাকে না। তাহার প্রত্যেক অংশ সমগ্রের সুখে সুখী; তাহারা ভাবে ‘আমরা যে আপনারা সুন্দর সে কেবল সমগ্রকে সুন্দর করিয়া তুলিবার জন্য’। তাহারা যদি স্ব-স্বপ্রধান হইত, তাহারা যদি সকলেই মনে করিত ‘আর সকলের চেয়ে আমিই মস্ত লোক হইয়া উঠিব’, একজন আর একজনকে না মানিত, তাহা হইলে, না তাহারা নিজে সুন্দর হইত, না তাহাদের সমগ্রটি সুন্দর হইয়া উঠিত। তাহা হইলে একটা বাঁকাচোরা হ্রস্বদীর্ঘ উঁচুনীচু বিশৃঙ্খল চক্ষুশূল জন্মগ্রহণ করিত। অতএব দেখা যাইতেছে, যথার্থ যে সুন্দর সে প্রেমের আদর্শ। সে প্রেমের প্রভাবেই সুন্দর হইয়াছে; তাহার আদ্যন্তমধ্য প্রেমের সূত্রে গাঁথা; তাহার কোোনখানে বিরোধ বিদ্বেষ নাই। প্রেমের শতদল একটি বৃন্তের উপরে কি মধুর প্রেমে মিলিয়া থাকে! তাই তাহাকে দেখিতে ভাল লাগে। তাহার কোমলতা মধুর; কারণ কোমলতা প্রেম, কোমলতা কাহাকেও আঘাত করে না, কোমলতা সকলের গায়ে করুণ হস্তক্ষেপ করে, সে চোখের পাতায় স্নেহ আকর্ষণ করিয়া আনে। ইন্দ্রধনুর রঙগুলি প্রেমের রঙ, তাহাদের মধ্যে কেমন মিল! তাহারা সকলেই সকলের জন্য জায়গা রাখিয়াছে, কেহ কাহাকেও দূর করিতে চায় না, তাহারা সুরবালিকাদের মত হাত-ধরাধরি করিয়া দেখা দেয়, গলাগলি করিয়া মিলাইয়া যায়। গানের সুরগুলি প্রেমের সুর, তাহারা সকলে মিলিয়া খেলাইতে থাকে, তাহারা পরস্পরকে সাজাইয়া দেয়, তাহারা আপনার সঙ্গিনীদের দূর হইতে ডাকিয়া আনে! এই জন্যই সৌন্দর্য মনের মধ্যে প্রেম জন্মাইয়া দেয়, সে আপনার প্রেমে অন্যকে প্রেমিক করিয়া তুলে, সে আপনি সুন্দর হইয়া অন্যকে সুন্দর করে।
যে সুন্দর, কেবল যে তাহার নিজের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে তাহা নয়; সৌন্দর্যের সামঞ্জস্য সমস্ত জগতের সঙ্গে। সৌন্দর্য জগতের অনুকূল। কদর্যতা সয়তানের দলভুক্ত। সে বিদ্রোহী। সে যে টিঁকিয়া থাকে সে কেবল মাত্র গায়ের জোরে। তাও সে থাকিত না, কারণ কতটুকুই বা তাহার গায়ে জোর—কিন্তু প্রকৃতি তাহা হইতেও বুঝি সৌন্দর্য অভিব্যক্ত করিবেন।
জগতের সাধারণের সহিত সৌন্দর্যের আশ্চর্য ঐক্য আছে। জগতের সর্বত্রই তাহার তুলনা, তাহার দোসর মেলে। এই জন্য সৌন্দর্যকে সকলের ভাল লাগে। সৌন্দর্য যদি একেবারেই নূতন হইত, খাপছাড়া হইত, হঠাৎ-বাবুর মত একটা কিম্ভূত পদার্থ হইত, তাহা হইলে কি তাহাকে আর কাহারও ভালো লাগিত?