অতএব জ্ঞান কবিতার বিষয় নহে। কবিতা চিরযৌবনা। এই বুড়ার সহিত বিবাহ দিয়া তাহাকে অল্প বয়সে বিধবা ও অনুমৃতা করা উচিত হয় না।
প্রকৃতির উদ্দেশ্য—জানানো নহে, অনুভব করানো। চারি দিক হইতে কেবল নানা উপায়ে হৃদয়-আকর্ষণের চেষ্টা হইতেছে। যে জড়হৃদয় তাহাকেও মুগ্ধ করিতে হইবে, দিবানিশি তাহার কেবল এই যত্ন। তাহার প্রধান ইচ্ছা এই যে, সকলের সকল ভাল লাগে, এত ভাল লাগে যে আপনাকে বা অপরকে কেহ যেন বিনাশ না করে, এত ভাল লাগে যে সকলে সকলের অনুকূল হয়। কারণ, এই ইচ্ছার উপর তাহার সমস্ত শুভ তাহার অস্তিত্ব নির্ভর করিতেছে। প্রথম অবস্থায় শাসনের দ্বারা প্রকৃতির এই উদ্দেশ্য সাধিত হয়। প্রথমে দেখিলে—জগৎকে ঘুষি মারিলে তোমার মুষ্টিতে গুরুতর আঘাত লাগে, ক্রমে দেখিলে—জগতের সাহায্য করিলে সেও তোমার সাহায্য করে। এরূপ শাসনে এরূপ স্বার্থপরতায় জগতের রক্ষা হয় বটে; কিন্তু তাহাতে আনন্দ কিছুই নাই, তাহাতে জড়ত্ব ও দাসত্বই অধিক। এই জন্য প্রকৃতিতে যেমন শাসনও আছে তেমনি সৌন্দর্য্যও আছে। প্রকৃতির অভিপ্রায় এই, যাহাতে শাসন চলিয়া গিয়া সৌন্দর্য্যের বিস্তার হয়। শাসনের রাজদণ্ড কাড়িয়া লইয়া সৌন্দর্য্যের মাথায় রাজছত্র ধরাই প্রকৃতির চরম উদ্দেশ্য। প্রকৃতি যদি নিষ্ঠুর শাসনপ্রিয় হইত, তাহা হইলে সৌন্দর্য্যের আবশ্যকই থাকিত না। তাহা হইলে প্রভাত মধুর হইত না, ফুল মধুর হইত না, মনুষ্যের মুখশ্রী মধুর হইত না। এই সকল মাধুর্য্যের দ্বারা বেষ্টিত হইয়া আমরা ক্রমশঃ স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হইতেছি। আমরা ভালবাসিব বলিয়া জগতের হিত সাধন করিব। তখন ভয় কোথায় থাকিবে! তখন সৌন্দর্য্য জগতের চতুর্দ্দিকে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে! অর্থাৎ আমাদের হৃদয়কমলশায়ী সুপ্ত সৌন্দর্য্য জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছেন। তিনি জাগিয়াই আমাদের চতুর্দ্দিকস্থ শাসনের সিপাহীগুলোর নাম কাটিয়া দিয়াছেন, জগতের চারি দিকে তাঁহার জয়জয়কার উঠিয়াছে।
কবিরা সেই সৌন্দর্য্যের কবি, তাঁহারা সেই স্বাধীনতার গান গাহিতেছেন, তাঁহারা সজীব মন্ত্রবলে হৃদয়ের বন্ধন মোচন করিতেছেন। তাঁহারা সেই শাসনহীন স্বাধীনতার জন্য আমাদের হৃদয়ে সিংহাসন নির্ম্মাণ করিতেছেন, সেই মহারাজা-কর্ত্তৃক রক্তপাতহীন জগৎজয়ের জন্য প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছেন; কবিরা তাঁহারই সৈন্য। তাঁহারা উপদেশ দিতে আসেন নাই। সজীবতা ও সৌন্দর্য্য লাভ করিবার জন্য কখন কখন তত্ত্ব তাঁহাদের দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হয়, তাঁহারা তত্ত্বর কাছে কখন উমেদারী করিতে