অবশেষে রাজধানীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। পরাজয় ও পলায়নের পরে সুজা নূতন সৈন্য সংগ্রহের চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন। কিন্তু রাজকোষে অধিক অর্থ নাই। প্রজাগণ করভারে পীড়িত। ইতিমধ্যে দারাকে পরাজিত ও নিহত করিয়া ঔরংজেব দিল্লির সিংহাসনে বসিয়াছেন। সুজা এই সংবাদ পাইয়া অত্যন্ত বিচলিত হইলেন। কিন্তু সৈন্যসামন্ত কিছুই প্রস্তুত ছিল না, এইজন্য কিছু সময় হাতে পাইবার আশায় তিনি ছল করিয়া ঔরংজেবের নিকট এক দূত পাঠাইয়া দিলেন। বলিয়া পাঠাইলেন যে, নয়নের - জ্যোতি হৃদয়ের - আনন্দ পরমস্নেহাস্পদ প্রিয়তম ভ্রাতা ঔরংজেব সিংহাসন-লাভে কৃতকার্য হইয়াছেন ইহাতে সুজা মৃতদেহে প্রাণ পাইলেন– এক্ষণে সুজার বাংলা-শাসন-ভার নূতন সম্রাট মঞ্জুর করিলেই আনন্দের আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। ঔরংজেব অত্যন্ত সমাদরের সহিত দূতকে আহ্বান করিলেন। সুজার শরীর-মনের স্বাস্থ্য এবং সুজার পরিবারের মঙ্গল-সংবাদ জানিবার জন্য সবিশেষ ঔৎসুক্য প্রকাশ করিলেন এবং বলিলেন, “যখন স্বয়ং সম্রাট শাজাহান সুজাকে বাংলার শাসনকার্যে নিয়োগ করিয়াছেন, তখন আর দ্বিতীয় মঞ্জুরি-পত্রের কোনো আবশ্যক নাই।” এই সময় রঘুপতি সুজার সভায় গিয়া উপস্থিত হইলেন।
সুজা কৃতজ্ঞতা ও সমাদরের সহিত তাঁহার উদ্ধারকর্তাকে আহ্বান করিলেন। বলিলেন, “খবর কী?”
রঘুপতি বলিলেন, “বাদশাহের কাছে কিছু নিবেদন আছে।”
সুজা মনে মনে ভাবিলেন, নিবেদন আবার কিসের? কিছু অর্থ চাহিয়া না বসিলে বাঁচি।
রঘুপতি কহিলেন, “আমার প্রার্থনা এই যে– ”
সুজা কহিলেন, “ব্রাহ্মণ, তোমার প্রার্থনা আমি নিশ্চয় পূরণ করিব। কিন্তু কিছু দিন সবুর করো। এখন রাজকোষে অধিক অর্থ নাই।”
রঘুপতি কহিলেন, “শাহেন শা, রুপা সোনা বা আর কোনো ধাতু চাহি না, আমি এখন শাণিত ইস্পাত চাই। আমার নালিশ শুনুন, আমি বিচার প্রার্থনা করি।”
সুজা কহিলেন, “ভারী মুশকিল! এখন আমার বিচার করিবার সময় নহে। ব্রাহ্মণ, তুমি বড়ো অসময়ে আসিয়াছ।”
রঘুপতি কহিলেন, “শাহ্জাদা, সময় অসময় সকলেরই আছে। আপনি বাদশাহ, আপনারও আছে; এবং আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ, আমারও আছে। আপনার সময়মত আপনি বিচার করিতে বসিলে আমার সময় থাকে কোথা?”
সুজা হাল ছাড়িয়া দিয়া বলিলেন, “ভারী হাঙ্গাম! এত কথা শোনার চেয়ে তোমার নালিশ শোনা ভালো। বলিয়া যাও।”
রঘুপতি কহিলেন, “ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দমাণিক্য তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা নক্ষত্ররায়কে বিনা অপরাধে নির্বাসিত করিয়াছেন– ”
সুজা বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “ব্রাহ্মণ, তুমি পরের নালিশ লইয়া কেন আমার সময় নষ্ট করিতেছ। এখন এ - সমস্ত বিচার করিবার সময় নয়।”
রঘুপতি কহিলেন, “ফরিয়াদী রাজধানীতে হাজির আছেন।”
সুজা কহিলেন, “তিনি আপনি উপস্থিত থাকিয়া আপনার মুখে যখন নালিশ উত্থাপন করিবেন তখন বিবেচনা করা যাইবে।”
রঘুপতি কহিলেন, “তাঁহাকে কবে এখানে হাজির করিব?”
সুজা কহিলেন, “ব্রাহ্মণ কিছুতেই ছাড়ে না। আচ্ছা এক সপ্তাহ পরে আনিয়ো।”
রঘুপতি কহিলেন, “বাদশাহ যদি হুকুম করেন তো আমি তাহাকে কাল আনিব।”