মেটিয়াবুরুজ হইতে তাহার বাসার দিকে যখন গাড়ি ফিরিল তখন সকালের রৌদ্রে কলিকাতা শহর জাগিয়া উঠিয়াছে। হরলালের চোখে কিছুই পড়িল না। তাহার সমস্ত হতবুদ্ধি অন্তঃকরণ একটা কলেবরহীন নিদারুণ প্রতিকূলতাকে যেন কেবলই প্রাণপণে ঠেলা মারিতেছিল— কিন্তু কোথাও এক তিলও তাহাকে টলাইতে পারিতে ছিল না। যে বাসায় তাহার মা থাকেন, এতদিন সে বাসায় পা দিবামাত্র কর্মক্ষেত্রের সমস্ত ক্লান্তি ও সংঘাতের বেদনা মুহূর্তের মধেই তাহার দূর হইয়া গিয়াছে, সেই বাসার সম্মুখে গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইল— গাড়োয়ানের ভাড়া চুকাইয়া দিয়া সেই বাসার মধ্যে সে অপরিমেয় নৈরাশ্য ও ভয় লইয়া প্রবেশ করিল।
মা উদ্বিগ্ন হইয়া বারান্দায় দাঁড়াইয়া ছিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবা, কোথায় গিয়াছিলে।”
হরলাল বলিয়া উঠিল, “মা, তোমার জন্য বৌ আনিতে গিয়াছিলাম।” বলিয়া শুষ্ককণ্ঠে হাসিতে হাসিতে সেইখানেই মূর্ছিত হইয়া পড়িয়া গেল।
“ও মা, কী হইল গো” বলিয়া মা তাড়াতাড়ি জল আনিয়া তাহার মুখে জলের ঝাপটা দিতে লাগিলেন।
কিছুক্ষণ পরে হরলাল চোখ খুলিয়া, শূন্য দৃষ্টিতে চারি দিকে চাহিয়া উঠিয়া বসিল। হরলাল কহিল, “মা, তোমরা ব্যস্ত হইয়ো না। আমাকে একটু একলা থাকিতে দাও।” বলিয়া সে তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াই ভিতর হইতে দরজা বন্ধ করিয়া দিল। মা দরজার বাহিরে মাটির উপর বসিয়া পড়িলেন— ফাল্গুনের রৌদ্র তাহার সর্বাঙ্গে আসিয়া পড়িল। তিনি রুদ্ধ দরজার উপর মাথা রাখিয়া, থাকিয়া থাকিয়া কেবল ডাকিতে লাগিলেন, “হরলাল, বাবা হরলাল।”
হরলাল কহিল, “মা, একটু পরেই আমি বাহির হইব, এখন তুমি যাও।”
মা রৌদ্রে সেইখানেই বসিয়া জপ করিতে লাগিলেন।
আপিসের দরোয়ান আসিয়া দরজায় ঘা দিয়া কহিল, “বাবু,এখনই না বাহির হইলে আর গাড়ি পাওয়া যাইবে না।”
হরলাল ভিতর হইতে কহিল, “আজ সাতটার গাড়িতে যাওয়া হইবে না।”
দরোয়ান কহিল, “তবে কখন যাইবেন।”
হরলাল কহিল, “সে আমি তোমাকে পরে বলিব।”
দরোয়ান মাথা নাড়িয়া হাত উলটাইয়া নীচে চলিয়া গেল।
হরলাল ভাবিতে লাগিল, ‘এ কথা বলি কাহাকে। এ যে চুরি। বেণুকে কী জেলে দিব।’
হঠাৎ সেই গহনার কথা মনে পড়িল। সে কথাটা একেবারেই ভুলিয়া গিয়াছিল। মনে হইল, যেন কিনারা পাওয়া গেল। ব্যাগ খুলিয়া দেখে তাহার মধ্যে শুধু আংটি, ঘড়ি, বোতাম হার নহে— ব্রেস্লেট, চিক, সিঁথি, মুক্তার মালা প্রভৃতি আরো অনেক দামী গহনা আছে। তাহার দাম তিন হাজার টাকার অনেক বেশি। কিন্তু এও তো চুরি। এও তো বেণুর নয়। এ ব্যাগ যতক্ষণ তাহার ঘরে থাকে ততক্ষণ তাহার বিপদ।
তখন আর দেরি না করিয়া অধরলালের সেই চিঠি ও ব্যাগ লইয়া হরলাল ঘর হইতে বাহির হইল।
মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় যাও, বাবা।”
হরলাল কহিল, “অধরবাবুর বাড়িতে।”
মার বুক হইতে হঠাৎ অনির্দিষ্ট ভয়ের একটা মস্ত বোঝা নামিয়া গেল। তিনি স্থির করিলেন, ঐ-যে হরলাল কাল শুনিয়াছে বেণুর বাপের বিয়ে, তাই শুনিয়া অবধি বাছার মনে শান্তি নাই। আহা, বেণুকে কত ভালোই বাসে।
মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “আজ তবে তোমার আর মফস্বলে যাওয়া হইবে না? ”