তাড়াতাড়ি গাড়ির কাছে আসিয়া দেখিল, গাড়ির ভিতরে তাহাদের আপিসের একজন সাহেব বসিয়া আছে। সাহেব হরলালকে দেখিয়াই গাড়ি হইতে নামিয়া তাহার হাত ধরিয়া বাড়িতে প্রবেশ করিল। জিজ্ঞাসা করিল, “আজ মফস্বলে গেলে না কেন।”
আপিসের দরোয়ান সন্দেহ করিয়া বড়োসাহেবকে গিয়া জানাইয়াছে— তিনি ইহাকে পাঠাইয়াছেন।
হরলাল বলিল, “তিন হাজার টাকার নোট পাওয়া যাইতেছে না।”
সাহেব জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় গেল? ”
হরলাল ‘জানি না’ এমন উত্তরও দিতে পারিল না, চুপ করিয়া রহিল।
সাহেব কহিল, “টাকা কোথায় আছে দেখিব চলো।”
হরলাল তাহাকে উপরের ঘরে লইয়া গেল। সাহেব সমস্ত গনিয়া চারি দিক খুঁজিয়া-পাতিয়া দেখিল। বাড়ির সমস্ত ঘর তন্ন-তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিতে লাগিল। এই-সমস্ত ব্যাপার দেখিয়া মা আর থাকিতে পারিলেন না— তিনি সাহেবের সামনেই বাহির হইয়া ব্যাকুল হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ওরে হরলাল, কী হইল রে।”
হরলাল কহিল, “মা, টাকা চুরি গেছে।”
মা কহিলেন, “চুরি কেমন করিয়া যাইবে। হরলাল,এমন সর্বনাশ কে করিল!”
হরলাল কহিল, “মা, চুপ করো।”
সন্ধান শেষ করিয়া সাহেব জিজ্ঞাসা করিল, “এ ঘরে রাত্রে কে ছিল।”
হরলাল কহিল, “দ্বার বন্ধ করিয়া আমি একলা শুইয়াছিলাম— আর-কেহ ছিল না।”
সাহেব টাকাগুলা গাড়িতে তুলিয়া হরলালকে কহিল, “আচ্ছা, বড়োসাহেবের কাছে চলো।”
হরলালকে সাহেবের সঙ্গে চলিয়া যাইতে দেখিয়া মা তাহাদের পথ রোধ করিয়া কহিল, “সাহেব, আমার ছেলেকে কোথায় লইয়া যাইবে। আমি না খাইয়া এ ছেলে মানুষ করিয়াছি— আমার ছেলে কখনোই পরের টাকায় হাত দিবে না।”
সাহেব বাংলা কথা কিছু না বুঝিয়া কহিল, “আচ্ছা, আচ্ছা!”
হরলাল কহিল, “মা, তুমি কেন ব্যস্ত হইতেছ। বড়োসাহেবের সঙ্গে দেখা করিয়া আমি এখনই আসিতেছি।”
মা উদ্বিগ্ন হইয়া কহিলেন, “তুই যে সকাল থেকে কিছুই খাস নাই।”
সে কথার কোনো উত্তর না দিয়া হরলাল গাড়িতে উঠিয়া চলিয়া গেল। মা মেজের উপরে লুটাইয়া পড়িয়া রহিলেন।
বড়োসাহেব হরলালকে কহিলেন, “সত্য করিয়া বলো ব্যাপারখানা কী।”
হরলাল কহিল, “আমি টাকা লই নাই।”
বড়োসাহেব। সে কথা আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি। কিন্তু তুমি নিশ্চয় জান কে লইয়াছে।
হরলাল কোনো উওর না দিয়া মুখ নিচু করিয়া বসিয়া রহিল।
সাহেব। তোমার জ্ঞাতসারে এ টাকা কেহ লইয়াছে?
হরলাল কহিল, “আমার প্রাণ থাকিতে আমার জ্ঞাতসারে এ টাকা কেহ লইতে পারিত না।”
বড়োসাহেব কহিলেন, “দেখো হরলাল, আমি তোমাকে বিশ্বাস করিয়া কোনো জামিন না লইয়া এই দায়িত্বের কাজ দিয়াছিলাম। আপিসের সকলেই বিরোধী ছিল। তিন হাজার টাকা কিছুই বেশি নয়। কিন্তু তুমি আমাকে বড়ো লজ্জাতেই ফেলিবে। আজ সমস্ত দিন তোমাকে সময় দিলাম— যেমন করিয়া পার টাকা সংগ্রহ করিয়া আনো— তাহা হইলে এ লইয়া কোনো কথা তুলিব না, তুমি যেমন কাজ করিতেছ তেমনি করিবে।”