কী! আমার গায়ে হাত! আমি হাত ছিনিয়ে নিয়ে তার গালে এক চড় কষিয়ে দিলুম। এমন সময়ে মক্ষী ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই দেখে দরোয়ান আমাকে অপমান করবার উপক্রম করছে।
তাই সেই মূর্তি আমি কখনো ভুলব না। মক্ষী যে সুন্দরী সেটা আমার আবিষ্কার। আমাদের দেশে অধিকাংশ লোক ওর দিকে তাকাবে না। লম্বা ছিপ্ছিপে গড়ন, যাকে আমাদের রূপরসজ্ঞ লোকেরা নিন্দে করে বলে ‘ঢ্যাঙা’। ওর ঐ লম্বা গড়নটিই আমাকে মুগ্ধ করে ; যেন প্রাণের ফোয়ারার ধারা, সৃষ্টিকর্তার হৃদয়গুহা থেকে বেগে উপরের দিকে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। ওর রঙ শামলা, কিন্তু সে যে ইস্পাতের তলোয়ারের মতো শামলা— কী তেজ আর কী ধার! সেই তেজ সেদিন ওর সমস্ত মুখে চোখে ঝিক্মিক্ করে উঠল। চৌকাঠের উপর দাঁড়িয়ে তর্জনী তুলে রানী বললে, নন্কু, চলা যাও।
আমি বললুম, আপনি রাগ করবেন না, নিষেধ যখন আছে তখন আমিই চলে যাচ্ছি।
মক্ষী কম্পিতস্বরে বললে, না, আপনি যাবেন না, ঘরে আসুন।
এ তো অনুরোধ নয়, এ হুকুম। আমি ঘরে এসে চৌকিতে বসে একটা হাতপাখা নিয়ে হাওয়া খেতে লাগলুম। মক্ষী একটা কাগজের টুকরোয় পেন্সিল দিয়ে কী লিখে বেহারাকে ডেকে বললে, বাবুকে দিয়ে এসো।
আমি বললুম, আমাকে মাপ করবেন, ধৈর্য রাখতে পারি নি, দরোয়ানটাকে মেরেছি।
মক্ষী বললে, বেশ করেছেন।
কিন্তু ও বেচারার তো কোনো দোষ নেই, ও তো কর্তব্য পালন করেছে।
এমন সময় নিখিল ঘরে ঢুকল। আমি দ্রুত চৌকি থেকে উঠে তার দিকে পিঠ করে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম।
মক্ষী নিখিলকে বললে, আজ নন্কু দরোয়ান সন্দীপবাবুকে অপমান করেছে।
নিখিল এমনি ভালোমানুষের মতো আশ্চর্য হয়ে বললে ‘কেন’ যে আমি আর থাকতে পারলুম না। মুখ ফিরিয়ে তার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকালুম ; ভাবলুম সাধুলোকের সত্যের বড়াই স্ত্রীর কাছে টেঁকে না, যদি তেমন স্ত্রী হয়।
মক্ষী বললে, সন্দীপবাবু বৈঠকখানায় আসছিলেন, সে ওঁর পথ আটক করে বললে হুকুম নেই।
নিখিল জিজ্ঞাসা করলে, কার হুকুম নেই?
মক্ষী বললে, তা কেমন করে বলব!
রাগে ক্ষোভে মক্ষীর চোখ দিয়ে জল পড়ে-পড়ে আর-কি।
দরোয়ানকে নিখিল ডেকে পাঠালে। সে বললে, হুজুর, আমার তো কসুর নেই। হুকুম তামিল করেছি।
কার হুকুম?
বড়োরানীমা মেজোরানীমা আমাকে ডেকে বলে দিয়েছেন।
ক্ষণকালের জন্যে সবাই আমরা চুপ করে রইলুম।
দরোয়ান চলে গেলে মক্ষী বললে, নন্কুকে ছাড়িয়ে দিতে হবে।
নিখিল চুপ করে রইল। আমি বুঝলুম ওর ন্যায়বুদ্ধিতে খট্কা লাগল। ওর খট্কার আর অন্ত নেই।
কিন্তু বড়ো শক্ত সমস্যা! সোজা মেয়ে তো নয়। নন্কুকে ছাড়ানোর উপলক্ষে জায়েদের উপর অপমানের শোধ তোলা চাই।
নিখিল চুপ করেই রইল। তখন মক্ষীর চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে পড়তে লাগল। নিখিলের ভালোমানুষির ’পরে তার ঘৃণার