তবর্গ বা প্রৌঢ়। ‘ট’য়ে যাহা কঠিন ছিল, ‘ত’য়ে তাহা শিথিল (ত)লতোলে হইয়া পড়িয়াছে। এখন (ত)লাইয়া বুঝিবার কাল। যৌবনে উপরে উপরে যাহা চক্ষে পড়িত, তাহাই খাঁটি বলিয়া মনে হইত, এখন না (ত) লাইয়া কিছু বিশ্বাস হয় না। মনের দরজায় একটা (তা)লা পড়িয়াছে। যৌবনে এক মুহূর্তের তরে দ্বার বন্ধ করা মনে আসিত না; সেই অসাবধানে বিস্তর লোকসান হইয়াছে, এমন-কি, আস্ত মনটি চুরি গিয়াছে এবং সেই ডাকাতির সময় মনের সুখ শান্তি সমুদয় ভাঙিয়া চুরিয়া একেবারে নাস্তানাবুদ হইয়া গিয়াছে। কেহ-বা হারানো মন ভাঙাচোরা অবস্থায় উদ্ধার করিতে পারিয়াছেন, কেহ-বা পারেন নাই, আস্তে আস্তে দুয়ারে তালা লাগাইয়াছেন। ইঁহাদের মন (থি)তাইয়া আসিয়াছে, এক জায়গায় আসিয়া (দাঁ)ড়াইয়াছেন; মত বাঁধিয়াছেন, সংসার বাঁধিয়াছেন, ছেলেমেয়েদের বিবাহে বাঁধিয়াছেন। মাঝে মাঝে একটা একটা (ধা)ক্কা খাইতেছেন; (যৌবনের ন্যায় সামান্য ঠোকর খাওয়া নহে) উপযুক্ত পুত্র মরিয়া গেল, জামাই যথেচ্ছচারী হইয়া গিয়াছে, দেনায় বিষয় যায় যায়। অবশেষে তাহার মন (ন)রম হইয়া আসিয়াছে, তাহার শরীর মন (নু)ইয়া পড়িয়াছে। তবর্গে লোকে (তা)স্ খেলে, (তা)মাক খায়, (দা)লানে বসিয়া (দ)লাদলি করে, (নি)ন্দা করে ও (নি)দ্রা যায়। যৌবনে ঢুলিত মাত্র, এখন (নি)দ্রা আরম্ভ হইয়াছে। যাহা হউক, দন্ত্য ন শেষ হইল, দন্তেরও শেষ হইল।
পবর্গ বা বার্ধক্য। প্রৌঢ়ে যাহা নুইতে আরম্ভ করিয়াছিল, এখন তাহার (প)তন হইল। পতিত বৃক্ষকে যেমন সহস্র লতায় চারি দিক হইতে জড়াইয়া ধরে, তেমনি সংসারের সহস্র (ফাঁ)দে বৃদ্ধকে চারি দিক হইতে আচ্ছন্ন করে; ছেলে, মেয়ে, নাতি নাতনী ইত্যাদি। (বি)রাম, (বি)শ্রাম। (ভ্রা)ন্তি, (ভ)য়, (ভ)র, (ভি)ক্ষা ও অবশেষে (ম)রণ। ঢোলা নয়, নিদ্রা নয়, মহা নিদ্রা।
মানুষ (ক)(র্ম)-ক্ষেত্রে নামিল— ক হইতে আরম্ভ করিল, ম-য়ে শেষ করিল। কাঁদিয়া জন্মিল, ক্রন্দনের মধ্যে অপসারিত হইল। কিন্তু মানুষের এই সমগ্র জীবন আরম্ভ ক-বর্গের মধ্যে প্রতিবিম্বিত আছে। ক-বর্গে কী কী আছে? কাঁদা, খেলা, গেলা, ঘা লাগা ও উঁ আঁ করা। প্রথম কাঁদা, শৈশবের ক্রন্দন, দ্বিতীয় খেলা, কৈশোরের খেলা। তৃতীয় গেলা অর্থাৎ ভোগ, যৌবনের ভোগ। চতুর্থ ঘা লাগা, প্রৌঢ়ের শোক। পঞ্চম উঁ আঁ করা, বৃদ্ধের রোগ; বৃদ্ধের বিলাপ। জীবনের ভোজ অবসান হইলে যে-সকল ছেঁড়া পাত ভাঙা পাত্র, বিক্ষিপ্ত উচ্ছিষ্ট ইতস্তত পড়িয়া থাকে, তাহাও ক-বর্গের মধ্যে গিয়া পড়ে, যথা—(কা)ঠ, (খা)ট, (গ)ঙ্গার (ঘা)ট ও বিলাপের উঁ আঁ শব্দ। আরম্ভের সহিত অবসানের এমনি নিকট সম্বন্ধ!
অ আ প্রভৃতি স্বরবর্ণগুলি আমাদের জীবনের অনুভাবসমূহ। এগুলি ব্যতীত কোনো ব্যঞ্জনবর্ণ দাঁড়াইতে পারে না। জীবনের যে-কোনো ঘটনা ঘটুক-না তাহার সহিত একটা অনুভাবের স্বরবর্ণ লিপ্ত আছেই। কখনো বা তৃপ্তিসূচক আ, কখনো বা তীব্র যন্ত্রণা-সূচক ই, কখনো বা গভীর যন্ত্রণা-সূচক উ, আমাদের ঘটনার ব্যঞ্জনবর্ণে যুক্ত হয়। মর্ত্য-জীবনের বর্ণমালায় সমুদয় ব্যঞ্জনবর্ণের সহিত অভাব-সূচক ‘অ’ লিপ্ত থাকে। তাহাই তাহার মূল সহচর। অদৃষ্ট আমাদের এই-সকল অক্ষর সাজাইয়া এক-একটা গ্রন্থ রচনা করিতেছে। কাহারো বা কাব্য হয়, কাহারো বা দর্শন হয়, কাহারো বা ছাড়া ছাড়া অর্থহীন কতকগুলা অক্ষর-সমষ্টি হয় মাত্র, দেখিয়া মনে হয়, তাহার অদৃষ্ট হাত-পাকাইবার জন্য চিরজীবন কেবল মক্শো করিয়াই আসিতেছে, পদরচনা করিতে আর শিখিল না! এই-সকল রচনার খাতা হাতে করিয়া বোধ করি পরলোকে মহাগুরুর নিকটে গিয়া একদিন দাঁড়াইতে হইবে; তিনি যাহাকে যে শ্রেণীর উপযুক্ত বিবেচনা করিবেন, উত্তীর্ণ করিয়া দিবেন।