বিপাশা। মানব না ও কথা। কাশ্মীর জয় করেছ তোমরা! মানব না।
নরেশ। সুন্দরী, অরসিক ইতিহাস মধুর কণ্ঠের সম্মতির অপেক্ষা রাখে না।
বিপাশা। রাজকুমার, দাম্ভিক কণ্ঠের আস্ফালনের ভাষাও তার ভাষা নয়।
নরেশ। কিন্তু তলোয়ারের সাক্ষ্য তো মানতে হবে। যমরাজকে সামনে রেখে সে কথা কয়। আমাদের মহারাজ কাশ্মীর জয় করেছেন।
বিপাশা। করেন নি। আমাদের যুবরাজ ছিলেন অনুপস্থিত। মানস-সরোবর থেকে অভিষেকের জল আনতে গিয়েছিলেন। তাই যুদ্ধ হয় নি, দস্যুবৃত্তি হয়েছিল।
নরেশ। তাঁর পিতৃব্য চন্দ্রসেন ছিলেন প্রতিনিধি। যুদ্ধ করেছিলেন।
বিপাশা। যুদ্ধের ভান করেছিলেন। লুঠ-করা সিংহাসন হার-মানার ছদ্মমূল্যে নিজে কিনে নেবার জন্যে। তোমাদের সভাকবি এই নিয়ে সাত সর্গ কবিতা লিখেছেন। তোমাদের যুদ্ধ ফাঁকি, তোমাদের ইতিহাস ফাঁকি। চুপ করে হাসছ যে! লজ্জা নেই!
নরেশ। মহারানী সুমিত্রা তো ফাঁকি নন। তিনি তো পর্বত থেকে নেমে এসেছেন আমাদের জয়লক্ষ্মীর অনুবর্তিনী হয়ে।
বিপাশা। চুপ করো, চুপ করো। দুঃখের কথা মনে করিয়ে দিয়ো না। রাজকন্যা তখন বালিকা, বয়েস ষোলো। খুড়োমহারাজ এসে বললেন, বিজয়ীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে, নইলে সন্ধি অসম্ভব। রাজকুমারী আগুন জ্বালিয়ে ঝাঁপ দিয়ে মরতে গিয়েছিলেন। পুরবৃদ্ধরা এসে বললে, মা, রক্ষা করো, যে পাণি মৃত্যুবর্ষণ করছে তোমার পাণি দিয়ে তাকে অধিকার করো — শান্তি হোক।
নরেশ। কিন্তু সেদিনকার কোনো গ্লানি তো মহারানীর মনে নেই। প্রসন্ন মহিমায় সিংহাসনে তাঁর আপন স্থান নিয়েছেন।
বিপাশা। মহাদুঃখ ভোলবার মতোই মহাশক্তি তাঁর, তিনি যে সতীলক্ষ্মী। মৃত্যুর জন্যে যে আগুন জ্বলেছিল তাকে সাক্ষী করে তাঁর বিবাহ। তিনদিন কৈলাসনাথের মন্দিরে ধ্যানে বসে উপবাস করে নিজেকে শুদ্ধ করে নিয়েছেন। অসহ্য অপমানকে নিঃশেষে নিজের মধ্যে দগ্ধ করে নিয়ে তবে এলেন তোমাদের ঘরে। বীরাঙ্গনার ক্ষমা যদি না থাকত তবে আগুন ধরত তোমাদের সিংহাসনে।
নরেশ। জান বিপাশা, ঐ বীরাঙ্গনা আপন মহিমাচ্ছটায় কাশ্মীরের দিকে আমাদের হৃদয়ের একটি দীপ্যমান ছায়াপথ এঁকে দিয়েছেন। জালন্ধরের যুবকদের মন তিনি উদাস করেছেন ঐ কাশ্মীরের মুখে। তিনি তাদের ধ্যানের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছেন একটি অপরূপ জ্যোতিমূর্তি। তুমি জান না জালন্ধর থেকে কত পাগল গেছে ঐ কাশ্মীরে, খুঁজতে তাদের সাধনার ধনকে।
বিপাশা। হায় রে, এ তো যুদ্ধ করা নয়। ওখানে তোমাদের অস্ত্র চলবার রাস্তা থাকতেও পারে কিন্তু হৃদয়জয়ের পথ ও দিকে বন্ধ করে দিয়েছ তোমাদের বর্বরতা দিয়ে।
নরেশ। সাধনা করতে হবে — তাতেও তো আনন্দ আছে।
বিপাশা। তা করো, কিন্তু সিদ্ধির আশা ছেড়ে দাও।
নরেশ। সিদ্ধি হবেই, আমি একলাই তা প্রমাণ করব — কাশ্মীর পর্যন্ত না গিয়ে!
বিপাশা। তোমার যত বড়ো অহংকার তত বড়োই দুরাশা।
নরেশ। দুরাশাই আমার, সেই আমার অহংকার। আমার আকাঙ্খা পর্বতের দুর্গম শিখর। সেখানে প্রভাতের দুর্লভ তারাকে দেখি, ভোরের স্বপ্নে।