সুমিত্রা। কী করে মিলবে। প্রজারক্ষার করুণায় কাশ্মীরের অসম্মান স্বীকার ক'রে যেদিন আমি মহারাজের কাছে আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়েছিলুম তখন তিন দিন ধরে কৈলাসনাথের মন্দিরে কিসের জন্যে তপস্যা করেছি?
বিপাশা। আমি হলে জালন্ধরের বিনিপাতের জন্যে তপস্যা করতুম।
সুমিত্রা। এই শক্তি চেয়েছিলুম, রুদ্রের প্রসাদে আমার বিবাহ যেন ভোগের না হয়। জালন্ধরের রাজগৃহে আমি কোনোদিন কিছুর জন্যেই যেন লোভ না করি; তবেই আমাকে অপমান স্পর্শ করতে পারবে না।
বিপাশা। কোনোদিন তোমার মন বিচলিত হয় নি, মহারানী?
সুমিত্রা। প্রতিদিন হয়েছে — হাজারবার হয়েছে।
বিপাশা। মাপ করো মহারানী, আমার সন্দেহ হয় তুমি তাঁকে অবজ্ঞা কর।
সুমিত্রা। অবজ্ঞা! এমন কথা বলিস নে, বিপাশা। ওঁর মধ্যে তুচ্ছ কিছুই নেই। প্রচণ্ড ওঁর শক্তি — সে-শক্তিতে বিলাসের আবিলতা নেই, আছে উল্লাসের উদ্দামতা। আমি যদি সেই কূল-ভাঙা বন্যার ধারে এসে দাঁড়াতুম, তা হলে আমার সমস্ত কোথায় ভেসে যেত, ধর্মকর্ম, শিক্ষাদীক্ষা। ঐ শক্তির দুর্জয়তাকে অহরহ ঠেকাতে গিয়েই আমার মন এমন পাষাণ হয়ে উঠল। এত অজস্র দান কোনো নারী পায় না — এই দুর্লভ সৌভাগ্যকে প্রত্যাখ্যান করবার জন্যে নিজের সঙ্গে আমার এমন দুর্বিষহ দ্বন্দ্ব। মহারাজকে যদি অবজ্ঞা করতে পারতুম তাহলে তো সমস্তই সহজ হত। অন্তরে বাহিরে আমার দুঃখ ষে কত দুঃসহ তা তিনিই জানেন যাঁর কাছে ব্রত নিয়েছিলুম।
বিপাশা। ব্রত যেন রাখলে, মহারানী, কিন্তু ভালোবাসা!
সুমিত্রা। কী বলিস, বিপাশা। এই ব্রতই তো আমার ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, নইলে ধিক্কারের মধ্যে তলিয়ে যেত সে। প্রেম যদি লজ্জার বিষয় হয় তবে তার চেয়ে তার বিনাশ কী হতে পারে। আমার প্রেমকে বাঁচিয়েছেন তপস্বী মৃত্যুঞ্জয়। বিবাহের হোমাগ্নি থেকে আমার এ প্রেম গ্রহণ করেছি — আহুতির আর অন্ত নেই।
বিপাশা। নিষ্ঠুর তোমার দেবতা, আমি কিন্তু তাঁকে মানতে পারতুম না।
সুমিত্রা। কী করে জানলি। তিনি ডাক দিলেই তোকেও মানতে হত। কিন্তু বিপাশা, ব্রতের কথা প্রকাশ করা অপরাধ, আজ অন্যায় করলুম, ক্ষমা করুন আমার ব্রতপতি।
বিপাশা। আমাকে ক্ষমা করো, মহারানী। কিন্তু কোথায় চলেছ।
সুমিত্রা। দেবদত্ত ঠাকুরের কাছে শুনলুম উৎসব উপলক্ষে দূরের থেকে প্রজারা এসেছে। আজ মন্দিরের বাগানে তারা দর্শন পাবে। রাজা সেই সংবাদ পেয়ে শুনছি দ্বার রুদ্ধ করবার আদেশ করেছেন।
বিপাশা। তুমি কি সে দ্বার খোলাতে পারবে?
সুমিত্রা। হয়তো পারব না। তবুও দেখতে যাব যদি কোনোখানে তার কোনো ফাঁক থাকে।
বিপাশা। দ্বার রোধ করবার বিদ্যায় এরা এত নিপুণ যে, তার মধ্যে কোনো ত্রুটিই তুমি পাবে না— এ আমি বলে দিচ্ছি।
রত্নেশ্বর। ঠাকুর, দেবদত্ত ঠাকুর।
দেবদত্ত। আমাকে ডাক পেড়ে আমাকে সুদ্ধ বিপদে ফেলবে দেখছি। কেন, কী হয়েছে।