সুমিত্রা। তুমি কি তবে সন্দেহ করছ—
দেবদত্ত। সন্দেহ করছি কিন্তু নাম করছি নে।
সুমিত্রা। এও কি সহ্য করতে হবে।
দেবদত্ত। হবে বৈকি। প্রমাণ নেই যে।
সুমিত্রা। তাই বলে পাপিষ্ঠকে নিষ্কৃতি দেবে?
দেবদত্ত। নিষ্কৃতির সদুপায় পাপিষ্ঠ নিজেই জানে, আমাদের কিছুই করতে হবে না।
সুমিত্রা। ঠাকুর, তবে কিছুই করবে না?
দেবদত্ত। যদি সম্ভব হত নিজের অস্থি দিয়ে বজ্র তৈরি করে ওর মাথায় ভেঙে পড়তুম।
সুমিত্রা। তুমি বলতে চাও কিছুই করবার নেই? চুপ করে রইলে কেন ঠাকুর, লজ্জায়? পাছে কিছু করতে হয় সেই ভয়ে? আমি তো ধৈর্য রাখতে পারছি নে। বিপাশা, কী করছিস এখানে।
বিপাশা। অনঙ্গদেবের পূজায় মহারানীর জন্যে অর্ঘ্য সাজিয়ে এনেছি।
সুমিত্রা। ফেলে দে, ফেলে দে, দূর করে ফেলে দে সব। আমি যাব রুদ্রভৈরবের মন্দিরে, ঠাকুর, পূজা প্রস্তুত করো।
দেবদত্ত। পুরোহিত ত্রিবেদীকে মহারাজ তাঁর কাছে আজ নিযুক্ত করেছেন।
সুমিত্রা। তুমি হবে আমার পুরোহিত।
দেবদত্ত। আমি পুরোহিত?
সুমিত্রা। হাঁ তুমি। নীরব যে, মনে কি ভয় আছে।
দেবদত্ত। ভয় দেবতাকে। মুখে মন্ত্র পড়তে পারি, কিন্তু অন্তরের কথা যে অন্তর্যামী জানেন। কিন্তু মহারানী, ভৈরবের পূজায় তোমার কিসের প্রয়োজন।
সুমিত্রা। দুর্বল মন, শক্তি চাই।
বিপাশা। শক্তির দরকার যার সে তোমার নয়, সে মহারাজের। যে অসামান্য রূপ নিয়ে এসেছ সংসারে তার কাছে রাজলক্ষ্মী হার মেনেছেন— সেজন্যে দোষ দেব কাকে। যদি ক্ষমা কর তো বলি, দোষ তোমারই।
সুমিত্রা। বুঝিয়ে বলো।
বিপাশা। ঐ যে কাশ্মীরের নরাধমদের রাজ্যের হৃৎপিণ্ডের উপর বসিয়েছেন রাজা, তার কারণ শুনবে? রাগ করবে না?
সুমিত্রা। কারণ শুনতেই চাই আমি।
বিপাশা। প্রেমের গৌরব খুব প্রকাণ্ড করে জানাতে চেয়েছিলেন রাজা, খুব দুর্মূল্য দান দুঃসাহসের সঙ্গে দিতে পারলে তিনি বাঁচতেন। এই সামান্য কথাটা তুমি বুঝতে পার নি?
সুমিত্রা। আমি তো কোনো বাধা দিই নি।
বিপাশা। দাও নি বাধা? ঐ ভুবনমোহন রূপ নিয়ে কোথায় সুদূরে দাঁড়িয়ে রইলে তুমি। কিছু চাইলে না, কিছু নিলে না, এ কী নিষ্ঠুর নিরাসক্তি। তুমি রাজহংসীর মতো, রাজার তরঙ্গিত কামনাসাগরের জলে তোমার পাখা সিক্ত হতে চায় না, রাজবৈভবের জালে পারলে না তোমাকে একটুও বাঁধতে, তুমি যত রইলে মুক্ত, রাজা ততই হলেন বন্দী। শেষে একদিন আপন রাজ্যটাকে খণ্ড খণ্ড করে ছড়িয়ে ফেলে দিলেন ঐ কাশ্মীরী কুটুম্বদের হাতে— মনে করলেন তোমাকেই দেওয়া হল।