দিনের আলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এইবার অচিরার ঘরে ফেরবার সময়, কিংবা ওর দাদামশায় এসে ওকে বেড়াতে নিয়ে যাবেন। এমন সময়ে একজন হিন্দুস্থানী গোঁয়ার এসে অচিরার হাত থেকে হঠাৎ তার ব্যাগ আর ডায়ারিটা ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল, আমি সেই মুহূর্তেই বনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বললুম, “কোনো ভয় নেই আপনার।”— এই ব’লে ছুটে সেই লোকটার ঘাড়ের উপর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেই সে ব্যাগ আর খাতা ফেলে দৌড় মারলে। আমি লুঠের ধন নিয়ে এসে অচিরাকে দিলুম।
অচিরা বললে, “ভাগ্যিস আপনি—”
আমি বললুম, “আমার কথা বলবেন না, ভাগ্যিস ও লোকটা এসেছিল।”
“তার মানে? ”
“তার মানে, ওরই সাহায্যে আপনার সঙ্গে প্রথম কথাটা হয়ে গেল। এতদিন কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলুম না, কী যে বলি।”
“কিন্তু ও যে ডাকাত।”
“না, ও ডাকাত নয়, ও আমার বরকন্দাজ।”
অচিরা মুখে তার খয়েরী রঙের আঁচল তুলে ধ’রে খিল্খিল্ করে হেসে উঠল। কী মিষ্টি তার ধ্বনি, যেন ঝর্নার স্রোতে নুড়ির সুরওয়ালা শব্দ।
হাসি থামতেই বললে, “কিন্তু সত্যি হলে খুব মজা হত।”
“মজা হত কার পক্ষে।”
“যাকে নিয়ে ডাকাতি তার পক্ষে। এইরকম যে একটা গল্প পড়েছি।”
“তার পরে উদ্ধারকর্তার কী হত।”
“তাকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে চা খাইয়ে দিতুম।”
“আর এই ফাঁকি উদ্ধারকর্তার কী হবে।”
“তার তো আর-কিছুতে দরকার নেই। সে তো আলাপ করবার প্রথম কথাটা চেয়েছিল— পেয়েছে দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ পঞ্চম কথা।”
“গণিতের সংখ্যাগুলো হঠাৎ ফুরোবে না তো।”
“কেন ফুরোবে।”
“আচ্ছা, আপনি হলে আমাকে প্রথম কথাটা কী বলতেন।”
“আমি হলে বলতুম, রাস্তায় ঘাটে কতকগুলো নুড়ি কুড়িয়ে কী ছেলেমানুষি করছেন। আপনার কি বয়স হয় নি।”
“কেন বলেন নি।”
“ভয় করেছিল।”
“ভয়? আমাকে ভয়? ”
“আপনি যে বড়ো লোক। দাদুর কাছে শুনেছি। তিনি যে আপনার লেখা প্রবন্ধ বিলিতি কাগজে পড়েছিলেন। তিনি যা পড়েন আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন।”
“এটাও করেছিলেন? ”
“হাঁ, করেছিলেন। কিন্তু লাটিন নামের পাহারার ঘটা দেখে জোড়হাত ক’রে বলেছিলুম, দাদু, এটা থাক্, বরঞ্চ তোমার কোয়ন্টম থিয়োরির বইখানা নিয়ে আসি।”